১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১:৩০

স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের আগুনে না পোড়াই দেশকে

সড়ক দুর্ঘটনার নামে রাজপথে খুন হয়েছে মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ, কিন্তু তার বিচার করা যাবে না। বিচার করে যাবজ্জীবন দিলে জনগণকে জিম্মি করে চলবে পরিবহন ধর্মঘট। এ কেমন বাংলাদেশ! সড়কে যানবাহন চালকের অদক্ষতা, দায়িত্বহীনতায় মানুষ মরবে, কিছু বলা যাবে না। হাসপাতালে অযতœ-অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় রোগী মারা যাবে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যাবে না। শিক্ষাঙ্গনে বেতন বৃদ্ধির দাবি সরকার বিবেচনায় নেবে না, সে জন্য ক্লাস হবে না- এ চিত্র স্বাধীন দেশে বারবার কেন আমরা প্রত্যক্ষ করব? দেশের জনগণ কেন বারবার জিম্মি হবে? এ কি গণতন্ত্রের রূপ? স্বাধীন দেশের জনগণের প্রাপ্য? পরিবহন শ্রমিকের স্বেচ্ছাচারিতা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে? আমরা আর কতবার তাদের কাছে জিম্মি হব?

মানিকগঞ্জে ২০১১ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ ৫ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় যে মামলা হয়েছিল তার রায় হয়েছে গত বুধবার। চালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়ার প্রতিবাদে প্রথমে চুয়াডাঙ্গায় বাস-ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে ফ চালকের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার কারণে ৫টি জীবন অকালে ঝরে গেল। অথচ বিচার করে তার শাস্তি দেয়া যাবে না।

আশ্চর্য, সেলুকাস, কী বিচিত্র দেশ! আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খুলনাসহ ১০ জেলায় পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘটে গেছেন। লাখ লাখ মানুষকে জিম্মি করে পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করেছেন তারা। সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ খুন হয়েছে, আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, তাহলে কেন ধর্মঘট হবে? উচ্চ আদালত আছেন, আপিলের সুযোগ আছে। কিন্তু না, সে পথে হাঁটবেন না পরিবহন শ্রমিকরা। তাদের গডফাদাররা বলেন, ধর্মঘট নয়, অবসরে গেছেন শ্রমিকরা। তাতে কি দাঁড়ায়? হঠাৎ করে বিনা নোটিশে সড়কে লাখ লাখ যাত্রী অসহায় হয়ে পড়েন। দুর্ভোগের সীমা-পরিসীমা থাকে না।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৪৪ হাজার ৭১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫০ হাজার ৬২৭ জন নিহত এবং ৮২ হাজার ১০২ জন আহত হয়েছেন। প্রতি বছর ক্রমান্বয়ে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। ২০০৬ সালে ৩১৯৩ জন নিহত হলেও ২০১৫ সালে নিহতের সংখ্যা ৬৮২৩।

শনিবার দেশের ১১ জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে ১৭ জনের। গত ১ সপ্তাহে সারা দেশে প্রাণ যায় ৭০ জনের। ফেব্রুয়ারির এ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে ১৮১ জনের মৃত্যু ঘটেছে, রোববার মারা গেছেন ১০ জন। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে যে একেকটি সংসারের অনেক মানুষের নানা আশা-আকাক্সক্ষারও মৃত্যু ঘটছে সে খবর কেউই রাখেন না। বিষয়টা এমনও নয় যে, এই ২৫ দিনের মৃত্যু তালিকায় কেবল যাত্রী-পথচারীই আছেন। এ মৃত্যুর তালিকায় চালক, হেলপার এমনকি গাড়ির মালিকদের স্বজনরাও হয়তো আছেন।

আজ দেশের সড়কগুলো যেন ঔপন্যাসিক আলবেয়ার কামুর ভাষায় ‘কসাইখানা’ হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চাই সবার উদ্যোগ। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। চাই আইন ভাঙা নয়, আইন মানার সংস্কৃতি এবং তা সমাজের সর্বক্ষেত্রে।
স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা সীমাহীন নৈরাজ্যের বাসিন্দা। খোদ রাজধানী ঢাকা শহরের পথচারীদের পায়ে চলার পথ তো বটেই, এমনকি রাজপথ পর্যন্ত দখল করে হকাররা পসরা সাজিয়ে বসে থাকছে- মানুষের হাঁটার উপায় নেই- তাদের সরানো যাবে না। উপরন্তু তাদের তথাকথিত নেতারা দাবি জানাচ্ছে, সেখানে তাদের ‘বসার অধিকার’ দিতে হবে। এ কেমন ‘অধিকার’? এ কেমন ঔদ্ধত্য? এ কেমন দাবি? তাদের কে এ সত্য বোঝাবে যে, মানুষ যদি পথ চলতে না পারে, মানুষ যদি অফিস-আদালতে না যেতে পারে, মানুষের রুটি-রুজি যদি না থাকে, আয়-রোজগার না হয়- তাহলে তারা হাজার লাখো পণ্য সাজিয়ে ফুটপাতে গৃহ বানিয়ে বসে থাকলেও কেউ তাদের পণ্য কিনতে আসবে না, কিনতে পারবে না। খুব সোজা হিসাব-সোজা অংক। তারা সেটা না বুঝে কুড়াল মারছেন নিজের পায়েই।

আইন মানলে নিজের অধিকারই নিশ্চিত হয়, সংরক্ষিত হয়। না মানলে ক্ষতি নিজেরই- এ কথা দেশের পরিবহন শ্রমিক এবং তার নেতাদের বোঝাবেন কে? মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদের মামলার রায়ে একজন চালকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে অবৈধ ধর্মঘট ডেকে “একজন চালকের ‘অধিকার’ কিংবা ক্ষমতা”র পক্ষ নিয়ে তারা এ দেশের আরও লাখ লাখ চালকের অধিকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেছেন, সে কথা উপলব্ধি করতে পারছেন না। তারা অবস্থান নিয়েছেন জনসাধারণেরও বিপক্ষে। তারা নেতাদের উপস্থিতিতে চেয়ার ছোড়াছুড়ি করে এ ‘ধর্মঘট কর্মসূচি’ ‘আদায়’ করেছেন। নেতারা তাদের চেয়ার ছোড়াছুড়ির কারণে মঞ্চ থেকে চলে গেছেন এবং ফিরে এসে তাদের ‘চাহিদা পূরণ’ করেছেন। জনগণকে জিম্মি করার কর্মসূচি তারা চালাচ্ছেন- আত্মঘাতী এ কর্মকাণ্ডের কারণে তারা যে নিজেরাই নিজেদের জনবিচ্ছিন্ন শ্রেণীতে পরিণত করেছেন তা কি তারা বুঝতে পারবেন? বোধকরি নয়। কেননা যখন নেতারাও তাদের অযৌক্তিক, অনৈতিক ইচ্ছা পূরণের বাহনে পরিণত হয়েছেন সেখানে এ সামান্য বুঝ প্রত্যাশা করা অনুচিত বটে। এদের আর কী দুষব, যাদের ‘বোঝা’র কথা তারাও তো কম অবুঝ নন। আইনের পেশাই যাদের জীবিকা, যারা আইনের সংরক্ষক সেই আইনজীবীরাই তো এই ক’দিন আগে চট্টগ্রামে আদালত ভবনে ভাংচুর চালালেন। এ দেশে ডাক্তাররা রোগীকে হত্যা করছেন, ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা ভুল ওষুধ ধরিয়ে দিচ্ছেন, ফলে রোগীর মৃত্যু ঘটছে। আইনজীবীরা গাড়িচোর সিন্ডিকেট চালাচ্ছেন। হকাররা ফুটপাত নয়, রাস্তার মালিকানার দাবি জানাচ্ছে- সবাই কেবলই নিজে বাঁচতে চাইছে, তাতে অন্যের মৃত্যু হয় হোক। এটা মনুষ্য সমাজের নীতি নয়। এটা বর্বর জন্তুদের নীতি হলেও হতে পারে।

স্বাধীনতা শব্দটির আমরা অর্থ বানিয়ে ফেলেছি ‘যা ইচ্ছা তাই, যা ইচ্ছা চাই, যা ইচ্ছা পাই’- না পেলে লুটেপুটে খুন করে চাই। আমরা ভুলে গেছি স্বাধীনতার অর্থ ‘স্ব-অধীনতা’ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। নিজস্বতা অর্জনের ক্ষমতা। প্রকৃত ক্ষমতা।

পরিবহন শ্রমিকদের এ অনাকাক্সিক্ষত স্বেচ্ছাচারী ধর্মঘট সন্দেহ নেই- সমাজের সার্বিক নৈরাজ্য পরিস্থিতির অংশ। আমরা বলতে চাই, সর্বব্যাপী এ স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্যের সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। একটা প্রবাদ আছে- ‘আগুনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে আলো পাবে আর তাতে ব্যর্থ হলে সে কিন্তু সমস্তই পোড়াবে।’ পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে সঙ্গে কথাটি দেশের সব পেশার মানুষের প্রতি। অনুরোধ, আমরা যেন স্বীয় স্বার্থ উদ্ধারের আগুনে না পোড়াই আমাদের প্রিয় এ দেশটিকে।