১ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১:২৫

পরিবহনে অরাজকতা

আদালতের একটি রায়ের প্রতিবাদ জানাতে পুরো দেশ অচল করে দিয়েছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা। ফলে পরিবহন ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে চরম অরাজক পরিস্থিতি। আদালতের রায় তুলে নিতে পণবন্দী করা হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অভিযোগ উঠেছে, একজন মন্ত্রীর ইন্ধনে পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিকেরা মাঠে নেমেছেন। এ দিকে হঠাৎ করেই দেশজুড়ে পরিবহন ধর্মঘট ডাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের মানুষ। 

চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় বাসচালক জামির হোসেনকে সাজা দেয়ার প্রতিবাদে খুলনাসহ দেশের ১০ জেলায় গত কয়েক দিন ধরেই পরিবহন ধর্মঘট চলে আসছিল। এর সাথে সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ট্রাকচালক মীর হোসেনের মুক্তির দাবি যুক্ত হয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে হঠাৎ করে সেই ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। গত সোমবার রাতে পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর এক যৌথসভায় হঠাৎ করেই এ সিদ্ধান্ত নেয়ায় দেশের মানুষ চরম বিপাকে পড়ে। গতকাল সকালে অনেক মানুষ বাস টার্মিনালগুলোতে গিয়ে বাসায় ফিরতে বাধ্য হয়। এর আগে ‘চালকের সাজা মওকুফ, আইন অমান্য করে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়া এবং রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা কমানোর দাবিতে ২০ জেলায় ডাকা হয়েছিল দুই দিনের ধর্মঘট। ধর্মঘটের কারণে সারা দেশে পরিবহন খাতে নেমে এসেছে অরাজক পরিস্থিতি। সায়েদাবাদ টার্মিনালে গতকাল বিকেলে শামসুল আলম নামে এক যাত্রী বলেন, তিনি জানতেন না। বিকেলে তিনি এসে দেখেন কুমিল্লার কোনো গাড়ি ছাড়ছে না। ফলে চরম বিপদে পড়েছেন। সেই মিরপুর থেকে সায়েদাবাদ এসেছিলেন পরিবার পরিজন নিয়ে। অপর এক যাত্রী জানান, মাওয়ার গাড়িও ছাড়ছে না। ফলে শরীয়তপুর যাওয়ার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। 

ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো গাড়ি ছেড়ে যায়নি। ফলে বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার উদ্দেশে এসব টার্মিনালে আসা হাজার হাজার যাত্রীকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে দেখা যায়। গাবতলী ও সায়েদাবাদের কিছু স্থানে ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলে বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গাড়ি না পেয়ে রাস্তায় নাকাল হতে হয়েছে রাজধানীর ভেতরের বিভিন্ন রুটের যাত্রীদেরও। 

চুয়াডাঙ্গার পর গত সোমবার খুলনাসহ দেশের ১০ জেলায় পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয় মালিক শ্রমিকদের কয়েকটি সংগঠন। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই গতকাল সকাল থেকে একযোগে সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়। খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, পিরোজপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরিবহন ধর্মঘটের খবর আসছিল। গতকাল থেকে শুরু হয় সারা দেশে ধর্মঘট।

অভিযোগ উঠেছে, দেশের পরিবহন খাতে আন্দোলনের নামে চলা এসব বিশৃঙ্খলায় ইন্ধন দিচ্ছেন এক মন্ত্রী। ওই মন্ত্রী আবার পরিবহন শ্রমিকদেরও নেতা। এর আগেও তার ইন্ধনে কয়েকবার পরিবহন ধর্মঘট হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

এ দিকে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় বাসচালকের সাজা প্রত্যাহারসহ ‘চালকের সাজা মওকুফ, আইন অমান্য করে অতিরিক্ত পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়া এবং রাস্তায় পুলিশের তৎপরতা কমানোর দাবিতে আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়েছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের এসব কর্মকাণ্ড।

পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর শীর্ষ ফোরাম বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ছাড়া মালিকদের শীর্ষ সংগঠন হচ্ছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এর সভাপতি সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে যত পরিবহন ধর্মঘট হচ্ছে, এর প্রায় সব ক’টির পেছনেই এ দুইটি সংগঠন কিংবা তাদের স্থানীয় অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ধর্মঘট ডাকার পর সরকারের সাথে সালিস-মীমাংসার বৈঠকেও এ সংগঠনের নেতারা নেতৃত্ব দেন। নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অন্যতম নিয়ন্ত্রক বলে অনেকে জানিয়েছেন।

এ দিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের এসব ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলার রায়ের পর পরিবহন শ্রমিকেরা তার কাছে পরামর্শ চেয়েছিলেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, আদালতের রায় অমান্য করা যাবে না। রায়ে সন্তুষ্ট না হলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন। কিন্তু এরপরও অযৌক্তিক ধর্মঘট ডেকে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলা হয়েছে। এতে তাদের কোনো লাভ হবে না।

গত ২২ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের একটি আদালত বাসচালক জামির হোসেনকে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে অবহেলাজনিত মৃত্যুর জন্য (পরিকল্পিত নরহত্যা নয়) দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় এ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এ রায় প্রত্যাহারের দাবিতে শ্রমিক ও মালিকেরা ঐক্যবদ্ধভাবে নেমেছেন আন্দোলনে। তারই অংশ দেশজুড়ে পরিবহন ধর্মঘট।

টঙ্গী সংবাদদাতা জানান, টঙ্গীতে গতকাল পুলিশের সামনে শতাধিক যানবাহন ভাঙচুর করেছে পরিবহন শ্রমিকেরা। ভাঙচুরের ছবি তুলতে গেলে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকেরা। 

গাজীপুর জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের শ্রমিকেরা টঙ্গীতে মহাসড়কে দফায় দফায় তাণ্ডব চালায়। শ্রমিকেরা বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও প্রাইভেটকারসহ সব ধরনের যানবাহনে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছে। ভাঙচুরের সময় পুলিশ ছিল নির্বিকার। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ধর্মঘট কর্মসূচি থাকলেও বিকেল সাড়ে ৫টায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী প্রেস কাবের সামনে সব ধরনের পরিবহনে বেপরোয়া ভাঙচুর চালায় পরিবহন শ্রমিকেরা। তাদের ভাঙচুর থেকে রেহাই পায়নি মানবজীবন রাকারী ওষুধ পরিবহনকারী মিনি কাভার্ডভ্যান। প্রেস কাবের সামনে ভাঙচুরের এসব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতে গেলে পরিবহন শ্রমিকেরা দৈনিক মানবকণ্ঠের গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি ও টঙ্গী প্রেস কাবের বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হক ভূঁইয়ার ওপর চড়াও হয়। খবর পেয়ে অন্য সাংবাদিকেরা দ্রুত ঘটনাস্থলে গেলে উচ্ছৃঙ্খল পরিবহন শ্রমিকেরা লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে আসে। এ সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তারা কোনো ভূমিকা পালন করেনি।

সাভার (ঢাকা) সংবাদদাতা জানান, ঢাকার প্রবেশদ্বার গাবতলী থেকে দূরপাল্লøার কোনো গাড়ি না ছাড়ায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভারের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীদের বসে থাকতে এবং অনেককে হেঁটে যাতায়াত করতে দেখা যায়। ব্যাংক বীমা অফিসগুলোতে যারা ঢাকাসহ আশপাশের জেলা ও থানা থেকে এসে সাভারে অফিস করেন তাদের অনেককে অনুপস্থিত, আবার যারা আসেন তারাও অনেকে নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে পৌঁছতে পারেনি।