১০ জুন ২০২০, বুধবার

২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের বিবৃতি

বাজেটে শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা,রেশন ও আবাসনসহ ন্যায্য অধিকার পূরণে গুরুত্বপূর্ণ খাত সমূহে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দের আহ্বান -আ ন ম শামসুল ইসলাম

আগামী অর্থবছরের (২০২০-২১) বাজেটে শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, রেশন, আবাসন ব্যবস্থা, কৃষি খাত, শিল্প খাত, পাট শিল্প, গার্মেন্টস শিল্প, পরিবহন সেক্টর, প্রবাসীদের পূর্নবাসন, কর্মক্ষেত্রে নিহত ও আহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাবেক এমপি আ ন ম শামসুল ইসলাম। 

তিনি আসন্ন ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কালে গণমাধ্যমে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, চলমান করোনা মহামারির ফলে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ যারা দৈনিক ও চুক্তিভিত্তিক মজুরির ওপর নির্ভরশীল, তারা এক বড় ধরণের অর্থনৈতিক শঙ্কার মধ্যে পড়েছেন। একইসাথে প্রবাসী কর্মীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশে ফিরে এসেছেন এবং অনেকে কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রবাসী কর্মীসহ দেশের কর্মহীন জনগোষ্ঠীর জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি সহ শ্রমিকদের খাদ্য, আবাসন, চিকিৎসা ও শিক্ষা বাবদ ন্যায্য পাওনার জন্য বাজেটে বরাদ্দ দিতে হবে।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে যে সব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি:

১.স্বাস্থ্য খাত:
যারা জীবনীশক্তি ক্ষয় করে দেশের ৮৪ ভাগ রপ্তানি আয় করে সেই শ্রমিকদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বর্তমানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। বাজেটে এটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। করোনায় আক্রান্ত হবার পর যারা সুস্থ হয়ে উঠছেন, তারা কার্যত এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত হচ্ছেন না। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পুনর্বাসনের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা একান্তই জরুরি। জরুরি তহবিল গঠন করে আপদকালীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ড অনুযায়ী জনশক্তির বিন্যাস সাধন করতে হবে। সকল ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বীমা চালু করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং সরকারি তহবিল থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতাল সেবা থেকে উদ্ভূত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে এবং শ্রমজীবী হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিনা মূল্যে শ্রমিকদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে।

২.কৃষি খাতঃ
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি কৃষিকে আসন্ন বাজেটে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে। কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। মধ্যস্বত্বভূগীদের হাত থেকে কৃষক ও কৃষিপণ্যকে নিরাপদ রাখতে হবে। কৃষক ও কৃষিখাতকে রক্ষার জন্য কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি ধান ও কৃষিজাতপণ্য ক্রয় করতে হবে। কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু বিপনন ও কৃষকরা যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য পায় সে লক্ষ্যে কৃষি পণ্য বহনের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেন এবং সড়ক পথে পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ‘চাষীর বাড়ি, বাগান বাড়ি’ ধারণার ভিত্তিতে বাড়ি-ঘরের জমি সহ ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পোল্ট্রি, ডেইরি, ফিসারিজসহ গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথাযথ গুরুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতে হবে।অামরা মনে করি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে এ খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

৩. শিল্প খাত:
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র, মাঝারী ও কুটির শিল্পে প্রায় অড়াই কোটি নাগরিক কর্মরত। করোনা ভাইরাসের কারণে এদের সকলের আর্থিক জীবন হুমকির সন্মুখীন। দেশের অর্থনীতিতে শিল্প খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে বৈদিশিক মুদ্রা সাশ্রয় করছে। আমরা মনে করি ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে শিল্প খাতে যথার্থ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

৪. রেশন ও বাসস্থানঃ
শ্রমিকদের রেশন ও বাসস্থানের জন্য বরাদ্দের দাবি অনেক পুরনো। এই দাবির পক্ষে অতীতে সর্বত্র আবেদন জানানো হয়েছে। শ্রমিকরা রাস্তায় মিছিল করেছে। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। আজ থেকে ৪০ বছর আগেও শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ও বাসস্থানের সুবিধা ছিল।কিন্তু বর্তমানে সেসব কর্তন করা হয়েছে। তাই আগামী ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে শ্রমিকদের রেশন ও বাসস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে।

৫.পাট শিল্পঃ
বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও পাট পণ্যের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রাধান্য চলে এসেছে। পাট শিল্প শত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেও ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও ১শ’ কোটি মার্কিন ডলার রফতানি হয়েছে। এই শিল্পে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করা সম্ভব।কিন্তু পাটকলে যন্ত্রাংশ অন্যান্য শিল্পের মতো আধুনিকায়ন না হলে এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কমবে।এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী প্রদান এবং তা সঠিক সময়ে পরিশোধে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাই আসন্ন ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে পাট শিল্প খাত উন্নয়নে যথাযথ বরাদ্দ রাখতে হবে।

৬.গার্মেন্টস শিল্পঃ
দেশের ৮৪ শতাংশ রপ্তানি আয় আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে।দেশের প্রায় ৪৫ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকদের পরিবারের ৪ কোটি সদস্যের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ, এছাড়া দেশের ৫ হাজার ৫শ’ গার্মেন্টস কারখানায় স্বল্প মজুরী, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনিরাপদ সন্তান প্রসব ব্যবস্থা, পরিবহন সঙ্কট, শিল্প এলাকা ভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল, শিশু সন্তানদের জন্য ‘শিশু লালন কেন্দ্র’ শ্রমজীবী মা ও সন্তানদের জন্য অঞ্চলভিত্তিক ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন, নারী শ্রমিকদের জন্য ডরমিটরি স্থাপন করতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে।

৭.পরিবহন ও অন্যান্য সেক্টরঃ
পরিবহন খাতকে দেশের অর্থনীতির রক্তপ্রবাহের সাথে তুলনা করা যায়। প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে এই খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। যাত্রী, কৃষি ও শিল্প পণ্য পরিবহন, আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহন সহ সেবা খাতের এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে পরিবহণ খাত যুক্ত নয়। কিন্তু এখাতের সঙ্গে যুক্ত ৬০ লাখ শ্রমিকের চাইতে ঝুঁকিপূর্ণ আর কেউ নয়। এই ঝুঁকি শুধু দুর্ঘটনার নয় তাদের জীবিকা ও চাকুরিও ঝুঁকিপূর্ণ এবং নিরাপত্তাহীন। পরিবহন শ্রমিকরা তাদের কষ্টার্জিত অায়ের একটা অংশ দিয়ে গঠিত কল্যাণ তহবিলের সুবিধা যথাযথভাবে পাচ্ছেনা। এ কল্যাণ তহবিল তসরুপ হচ্ছে। যা বন্ধে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

এছাড়াও নির্মাণখাতের ৩০ লাখ, রি রোলিং, চা, তাঁত, রিক্সা, অটো রিকশা, ইজি বাইক, ছোট দোকানদার, চা দোকানদার, হকার, পর্যটনের সাথে যুক্ত বিভিন্ন পেশার মানুষ, গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, সেলুনকর্মী, পাদুকা শ্রমিক সহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক যাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ কোটি এবং যারা অর্থনীতিতে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখে তারা সব সময়ই উপেক্ষিত থাকে। কি বাজেটে, কি প্রণোদনা প্রাপ্তিতে তাদের অবস্থান নগন্য।তাই এসব খাতের ব্যাপারে কার্যকরী করনীয় নির্ধারণ ও বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখতে হবে।

৮.প্রবাসীদের পুনর্বাসনঃ
করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার শিকার হয়ে বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীগণ কর্মহারা অবস্থায় দেশে ফিরে আসছেন। রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। যেসব শ্রমিকগণ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারের ও কর্মহারা শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ থাকতে হবে।

৯. নিহত আহত হওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণঃ
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা দেশের উন্নয়নে কল- কারখানায় কাজ করে।কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় তারা দুর্ঘটনার শিকার হয়।এমনকি অনেকে মারাত্মকভাবে অাহত হয় এবং নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।অথচ তাদের চিকিৎসার জন্য এবং নিহতদের পরিবারের পূর্ণবাসনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়না। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেটে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুর্ণবাসনের জন্য বিশেষ তহবিল গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে।

১০. শ্রমিকদের দক্ষতাঃ
শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সেক্টর ও কারখানাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদাণের লক্ষ্যে (ক) প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, (খ) জেলা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ব্যয় এবং (গ) গবেষণা কার্য পরিচালনায় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা।

১১.জাতীয় পেনশন স্কিমঃ
জাতীয় পেনশন স্কিম প্রণয়নের মধ্য দিয়ে সকল শ্রমিকের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা।

উপরোক্ত বিষয়গুলোকে যথাযথ গুরুত্বসহকারে নিয়ে আগামী ২০২০-২০২১ অর্থ বছরের বাজেট প্রনয়ণের জন্য আমরা জোর দাবী জানাচ্ছি।