বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের এক বৈঠকে সংগঠনের আমীর ডা: শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে,
“বর্তমান সরকার বিগত ১৫ বছর যাবত নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়ে জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া অবৈধভাবে জগদ্দল পাথরের মত জাতির ঘাড়ে বসে আছে। জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নেই। সরকার দলীয় লোকেরা যে যেভাবে পারে দেশের সবকিছু লুটেপাট করে নিচ্ছে। এতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ অভিমত ব্যক্ত করছে যে, সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, ঘুষ ও লুটপাটের কারণে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে। সরকার দেশকে বিদেশী ঋণ নির্ভর দেশে পরিণত করেছে। গত ২০২৩-২৪ সালের বাজেটে এডিপির অর্ধেকও সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য হু হু করে বাড়ছেই। অব্যাহতভাবে লোডশেডিং চলছে। ফলে কলকারখানার উৎপাদন ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, সারাদেশে চলছে সরকার দলীয় টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করা সত্ত্বেও সরকারের মন্ত্রী এবং দলীয় নেতারা দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাট করে দেশে-বিদেশে নামে-বেনামে বহু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। জনগণের কষ্টের টাকা লুটপাট করে কানাডায় বেগমপাড়া, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম, সিংগাপুর ও দুবাইয়ে বিলাশ বহুল বাড়ি ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়েছে। সুইস ব্যাংকসহ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা করা হয়েছে। বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১১ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রকৃত পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি।
কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ গভীর উদ্বেগের সাথে আরও লক্ষ্য করছে যে, সরকারের সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, বিদেশে অর্থপাচার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিগত ১৫ বছরে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হলেও কাজ আজও শেষ হয়নি। দফায় দফায় ব্যয়ের অঙ্ক বৃদ্ধি করে টাকা লুটপাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ডেস্টিনি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রিজার্ভ ফান্ডের টাকা চুরি এবং সর্বশেষ ইসলামী ব্যাংকের অর্থ লুটপাট দুর্নীতির এক কলঙ্কজনক নজির হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আওয়ামী দলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতির ফিরিস্তি লিখে শেষ করা যাবে না। ফরিদপুরে দুই ভাইয়ের ২ হাজার কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎ, পিকে হালদারের হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থ কেলেঙ্কারিসহ অর্থ আত্মসাৎ ও লুটপাটের ঘটনায় দেশের আর্থিক কেলেঙ্কারির ভয়বহতা অনুমান করা যায়।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ চক্র ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দিচ্ছে না। বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সরকার দলীয় ব্যবসায়ীদের অবৈধ সুবিধা দেয়ার স্বার্থে অযৌক্তিক ঋণ অবলোপন ও পুনঃতফসিল করণের নামে প্রকৃতপক্ষে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু বানিয়েছে। দেশের সর্বত্রই শুধু দুর্নীতি আর দুর্নীতি। সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা, অবহেলা ও অমনোযোগিতার কারণে দেশের অর্থনীতির প্রধান খাত রেমিটেন্স প্রবাহে মন্থর গতি সৃষ্টি হয়েছে।
কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছে যে, দেশের রফতানি বাণিজ্য আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে আমদানিও কমে গিয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। ডলারের মূল্য ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে, খোলা বাজারে যার মূল্য ১২৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকা। আজকে দেশের ব্যাংকগুলো ডলারের অভাবে এলসি খুলতে অনীহা প্রকাশ করছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এমনকি জরুরি ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী পর্যন্ত আমদানি করা যাচ্ছে না। খাদ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ৯.৮১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশের ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে ভুগছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো অস্থিত্বের সংকটে পড়েছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ঋণ নিয়ে কোনোমতে চলছে। সম্প্রতি সরকার ২০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণের জন্য আবেদন করেছে। সরকার বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে আবার সে টাকা দিয়েই বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ করে। এভাবে সরকার নানাভাবে ঋণ করে গোজামিল দিয়ে কোনো রকমে ক্ষমতায় টিকে আছে। আজ দেশের শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ সকলেই চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছে।
দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে। ১০/১৫টি দুর্বল ব্যাংক বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কয়েকটি ইসলামী ব্যাংকে জবাবদিহিতা ছাড়াই টাকা ছাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এ খবরে দেশের অর্থনীতিবিদগণ এবং জনগণ গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। ব্যাংকে লুটপাট অব্যাহত থাকায় জনগণ আর ব্যাংকে টাকা রাখতে সাহস ও আস্থা পাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে স্থবিরতা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশে অর্থপাচার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সরকার অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে প্রতীয়মান হচ্ছে সরকার পরিকল্পিতভাবে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেশকে দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে গিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ এই মুহূর্তে লুটপাট বন্ধ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা এবং আসন্ন জাতীয় বাজেট ঘোষণার পূর্বে দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে বাস্তবসম্মত গণমুখী বাজেট প্রণয়ন করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।”