জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বলেছেন, পলাশীর ট্র্যাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দল মত ভুলে ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে পলাশীর ঘটনাকে মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে ক্ষমতা বড় নয়। মনে রাখতে হবে ব্যক্তির চেয়ে দল বড় আবার দলের চেয়ে দেশ বড়। তাই দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই আমাদের আজ বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ও এর উপর যেকোন আঘাত রুখে দেয়ার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে দেশবাসীকে সচেতন করার উপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
গতকাল বুধবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঐতিহাসিক পলাশী দিবস উপলক্ষে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহম্মদ রেজাউল করিমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমীর ও শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান, রমনা থানা জামায়াতের আমীর মুহম্মদ সেলিম উদ্দিন। বক্তব্য রাখেন শিবিরের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি মুহাম্মদ আতিকুর রহমান, পশ্চিম সভাপতি মুহাম্মদ মাকসুদুর রহমান, দক্ষিণ সভাপতি আবু সালেহ মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, পূর্ব সভাপতি মো: মনির উদ্দিন মণি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি মুহম্মদ মাকসুদুল ইসলাম প্রমুখ।
জনাব মুজাহিদ বলেন, আমাদের সীমান্ত ঘেঁষা কোন ভূখন্ড না হওয়া সত্ত্বেও কিভাবে বৃটিশরা আমাদের প্রায় দুশ' বছর শাসন করলো সেটি আজ ঐতিহাসিকভাবেই মূল্যায়ন করা দরকার। বিশেষ করে আগামী প্রজন্মকে আজ বিষয়টি মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদ আর আধিপত্যবাদীরা কখনো কোন দেশের স্বকীয়তার কথা কিংবা জাতিসত্তার নিজস্ব ইতিহাসের কথা জানতে দিতে চায় না বরং কৌশলে তারা সঠিক ইতিহাস ভুলিয়ে রাখতে চায়। তবে পলাশীর ঘটনাকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে জানাতে প্রয়োজনে পাঠ্যপুস্তকে এর ইতিহাসটি অন্তর্ভুক্ত করার জন্যও তিনি সরকারের প্রতি আবেদন জানান।
তিনি বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল একটি বেসরকারি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। রবার্ট ক্লাইভের পরিচালনায় এটি ছিল একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাকে দখল করার প্রক্রিয়াটি প্রকাশ্যে কিছুই বলেনি। শুধুমাত্র কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কিছু লোকের সাথে অাঁতাত করে তারা তাদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। তাদের এই ষড়যন্ত্র সে সময়ে যারা বুঝতে পেরেছিলেন তাদের পক্ষেও জনগণকে সচেতন করতে কোনভাবে প্রচার প্রচারণা চালানোর সুযোগ ছিল না। আর তখন মিডিয়া কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছিল নেহায়েত সামান্য। কাজেই কেউ কেউ ষড়যন্ত্র জানতে বুঝতে পারলেও সেই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার কোন সুযোগ ছিল না।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বর্তমান সময়েও কেউ কেউ দেশপ্রেমিক বা প্রগতিশীল কিংবা গণতন্ত্রের ধারক বাহক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে সাম্রাজ্যবাদ অথবা আধিপত্যবাদীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। তাদের এই আত্মধ্বংসী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন হতে হবে। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা ও পলাশীর ঘটনার পর আমাদের দেশে এক এগারোর ঘটনাটিও মূল্যায়নের দাবী রাখে উল্লেখ করে সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, এক এগারোর প্রেক্ষাপট তৈরির জন্যই এর আগে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর পল্টনের ট্র্যাজেডির সূত্রপাত করা হয়েছিল। এরপর সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় খুন, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের মতো ঘটনা ঘটানো হয়। পরবর্তীতে এটাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, ঐ দিনের এই নির্মম ও বর্বর হত্যাকান্ডটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা ছিল না।
তিনি বলেন, এক এগারোর পর যারা সংবিধান লংঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো তারা কুৎসিতভাবে দেশ চালালো। কিন্তু দুঃখজনক হলো ২৮ অক্টোবর যারা এমন অমানবিক ও বিশ্বের ঘৃণ্যতম একটি ঘটনা ঘটালো তারা চিহ্নিত হলো না, আজ পর্যন্ত কেউ দুঃখ প্রকাশও করলো না। তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বানচাল করতে একটি মহল শুরু থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। ২২ জানুয়ারির নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ১০ জানুয়ারী সেনাবাহিনীও মাঠে নামানো হয়েছিল। কিন্তু সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে একটি তাঁবেদার, অনুগত ও অকার্যকর ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। কিন্তু আমাদের সরকার সেটি বুঝতে পারছে কিনা জানি না। তিনি বলেন, ভারতের কারণে আমাদের দেশের ৫৪টি নদীর সবগুলোই আজ শুকিয়ে যাচ্ছে অথচ সরকার আবার ভারত থেকেই নদী খননের জন্য ড্রেজার আনার চিন্তা করছে। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ না নিয়ে সরকার ভারত থেকেই বিদ্যুৎ কেনারও চিন্তা করছে। তিনি বলেন, যে ভারতের কারণে আমাদের দেশের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে সেই ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহসও যেন সরকার হারিয়ে ফেলেছে।
তিনি বলেন, বিরোধী দলের কোন কথাও সরকার শুনছে না। সরকারের মনে রাখা দরকার বিরোধী দল দেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দেশের তিন তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সরকার আমাদের কথা বিশ্বাস করে না, তারা বিশ্বাস করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের কথা। তাই আমাদের শুধু আজ পলাশীর আলোচনা করেই বসে থাকলে চলবে না, দেশের ও দেশের মানুষের জন্য আমাদের এক একজনকে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদেরকে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দল মত ভুলে ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে পলাশীর ঘটনাকে মূল্যায়ন করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে ক্ষমতা বড় নয়। মনে রাখতে হবে ব্যক্তির চেয়ে দল বড় আবার দলের চেয়ে দেশ বড়। তাই দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই আমাদের আজ বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে। আব্দুল কাদের মোল্লা বলেন, পলাশীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনা অনুষ্ঠান করা এটা শুধু ছাত্রশিবিরের একার কাজ নয়। আমাদের সবাইকেই আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পলাশীর ঘটনাকে মূল্যায়ন করতে হবে, সচেতন হতে হবে এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, সরকার ভারতের সাথে চুক্তি করেছে অথচ দেশের জনগণ তা জানে না। এমপি মন্ত্রী এমনকি কেবিনেটেও নাকি এ ধরনের অনেক বিষয় জানানো হয় না। শিক্ষানীতি প্রসঙ্গে তিনি অভিযোগ করে বলেন, কবির চৌধুরীদের দ্বারা আগে পাস করানোর পরেই এই শিক্ষানীতি সরকার পাস করছে। সরকারের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় আগামীতে তরুণ পজন্মকেই আগে রাজপথে নামতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। রফিকুল ইসলাম খান বলেন, সেদিন পলাশীর প্রান্তরে নবাব পরাজয় বরণ করেননি। পরাজয় হয়েছে বিশ্বাস ঘাতকদের। তিনি বলেন, বর্তমানেও দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। পাশ্ববর্তীদের দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার কাজ করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তবে পলাশীর ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদেরকে আগামীতে জনতার ঐক্য গড়ে তুলতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আলোচনা সভার সভাপতির বক্তব্যে মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবরে পল্টন ময়দানে যে ট্রাজেডি ঘটিয়েছিল সেটা পলাশীর আম্রকাননের সে ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সেখানে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে অাঁতাত করেছিল মীর জাফর। আর ২৮ অক্টোবরের ট্রাজেডিসহ ১/১১ জরুরি সরকার প্রতিষ্ঠার পিছনে মীরজাফরের নামের সাথে মঈন-উ-আহমদ এর নাম মিলে যায়। আজকে যেমনিভাবে মীর জাফরের নাম কেউ রাখে না তেমনি আগামী দিনেও মঈন-উ-আহমদ নাম বাংলার জমিনে কেউ স্মরণ করা তো দূরের কথা ইতিহাসের কলঙ্কজনক নাম হিসেবে মনে রাখবে। পলাশীর সেই ট্রাজেডিতে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যেভাবে সিরাজউদ্দৌলা যেভাবে জীন দিয়েছিলেন আজও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লক্ষ জীবন দিতে প্রস্তুত শিবির সভাপতি রাবি ও ঢাবি প্রসঙ্গে আরো বলেন, দেশের এই দুটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে ভিসি বা প্রশাসন আছে বলে মনে হয় না। কারণ তারা শিক্ষামুখী কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বরং সন্ত্রাসীদেরকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। ছাত্রশিবির দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার আগে এসব কিছু থেকে ফিরে এসে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করুন। নচেৎ ছাত্রসমাজকে সাথে নিয়ে দুর্বার গড়ে তুলে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
কার্টেসীঃ দৈনিক সংগ্রাম