১ এপ্রিল ২০১৮, রবিবার

গণসংযোগ পক্ষ উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আহবান

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
গণসংযোগ পক্ষ উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আহবান

সম্মানিত দেশবাসী,

আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

বাংলাদেশ ৪৭-তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন করেছে মাত্র কয়েকদিন আগে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন সে সকল শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং আপনাদেরকে জানাচ্ছি আন্তরিক শুভেচ্ছা।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
যুগে যুগে আল্লাহর পথে আহ্বান করতেই নবী-রাসূলগণের পৃথিবীতে আগমন। আল্লাহ বলেন, “আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করো এবং তাগুতকে অস্বীকার করো।” (১৬:৩৬) মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এ দায়িত্বকে কখনো দাওয়াত, কখনো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ, কখনো প্রচার, কখনো নসিহত ও কখনো দীন প্রতিষ্ঠার আহ্বান বলে অভিহিত করা হয়েছে।

মূলত মুমিন জীবনের অন্যতম দায়িত্ব এই দাওয়াতি কাজ। আল্লাহ বলেন- “সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো ‘আমি মুসলমান’৷ (৪১:৩৩) মহান আল্লাহ তাআলা এই বিশ্ব ব্যবস্থা সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য দিয়েছেন তার মনোনীত জীবন বিধান আল-ইসলাম। তিনি বিশাল সৃষ্টি জগতের অগণিত মাখলুকাতের মধ্যে মানুষকে দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্ব। আর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর হুকুম পালনের জন্যে। আল্লাহ বলেন- “আমি মানুষ ও জ্বিন জাতিকে আমার ইবাদাতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।” (৫১: ৫৬)।মানুষ নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর নির্দেশনা অনুসরণ করবে।দীনের প্রচার ও প্রসার করার মাধ্যমে আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে- এটাই মুমিনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।

দুনিয়াতে আল্লাহর কাছে একমাত্র গ্রহণযোগ্য দীন (জীবন ব্যবস্থা) হচ্ছে আল-ইসলাম। মানুষের সার্বিক জীবনের মুক্তির জন্য ইসলামকে আংশিকভাবে মেনে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। বরং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়সহ জীবনের সর্বক্ষেত্রেইসলামের অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ বলেন- “হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো, আর জীবনের কোন অংশে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।” (২:২০৮) দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। মুমিনের প্রকৃত সফলতা হচ্ছে আখেরাত।আল্লাহ বলেন- “সে আখেরাতের গৃহ তো আমি তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দেবো যারা পৃথিবীতে নিজেদের বড়াই চায় না এবং চায় না বিপর্যয় সৃষ্টি করতে। আর শুভ পরিণাম রয়েছে মুত্তাকীদের জন্যই।” (২৮:৮৩)আল্লাহ তাআলা আরো বলেন- “দুনিয়ার জীবন তো একটি খেল-তামাসার ব্যাপার। আসলে যারা ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে চায় তাদের জন্য আখেরাতের আবাসই ভালো।তবে কি তোমরা বুদ্ধি-বিবেচনাকে কাজে লাগাবে না ?” (৬:৩২)

রাসূল (সা.) বলেছেন- “যে ব্যক্তি নিজের নাফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে। সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কুপ্রবৃত্তির গোলাম বানায় অথচ আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা করে সেই অক্ষম।” (তিরমিযী) সুতরাং প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে কু-প্রবৃত্তির তাবেদারি না করে আল্লাহর গোলামী করা। তাহলেই কেবল ইহকালিন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব।

প্রিয়বন্ধুগণ,
বর্তমানে প্রায় ১৭০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে মুসলিম উম্মাহ। যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ। কিন্তু তারপরও বিশ্বে মুসলমানগণ নির্যাতিত, নিগৃহীত, অবহেলিত ও পদদলিত। আজ অনৈক্য, হানাহানি, দরিদ্রতা ও নেতৃত্বের সংকটে আবর্তিত মুসলিম বিশ্ব। ইসলাম বিরোধী সম্প্রদায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। অথচ মুসলমানদেরই হওয়ার কথা ছিল সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ। আল্লাহ বলেন- “তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো এবং দলাদলি করো না।” (৩:১০৩) অন্যত্র আল্লাহ বলেন- “তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেই সব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং (হে মুহাম্মাদ) যা এখন আমি তোমার কাছে ওহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছিলাম আমি ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা-কে।তার সাথে তাগিদ করেছিলাম এই বলে যে, এ দীনকে কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (৪২:১৩)

বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে রাসূল (সা.) বলেছেন- “আজ আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি- এক. আল্লাহর কিতাব আর অপরটি আমার সুন্নাত”। তোমরা যতদিন পর্যন্ত এ দুটির অনুসরণ করবে ততদিন পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হবে না। আর মুসলমানরা যতদিন পর্যন্ত এর অনুসরণ করেছে ততদিন জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সাহিত্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে গোটা দুনিয়ায় নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। সুতরাং আজকের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে আমরা যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাই তাহলে কুরআন ও সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করার কোন বিকল্প নেই।


প্রিয় দেশবাসী,
অনেক ত্যাগ ও কোরবানীর বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে। গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, মানবিক মর্যাদাসহ মৌলিক অধিকারের দাবি সামনে রেখে যে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল সেই দেশের গণতন্ত্র, বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার আজ চরম হুমকির মুখে। দুর্নীতি, দলীয়করণ, খুন, গুম, অপহরণ, নারী-শিশু নির্যাতন ও হত্যাসহ এমন কোন অপকর্ম নেই যা সংঘটিত হচ্ছে না। তেল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।কিন্তু সরকার সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে ৫ জানুয়ারির মতো ভোটারবিহীন আরেকটি নীল-নকশার নির্বাচনের জন্যমরিয়া হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলের উপর চালাচ্ছে দমন-নিপীড়ন। বিশেষ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উপর চালানো হচ্ছে অত্যাচারের স্টীম রোলার। জামায়াতকে নির্মূল করার জন্য শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মিথ্যা মামলা দিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর জনাব মকবুল আহমাদসহ হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। গোটা দেশকেই কারাগারে পরিণত করেছে এই সরকার।

সুপ্রিয় দেশবাসী,
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলের ভিতরে গণতন্ত্রের চর্চা করে আসছে। গণতন্ত্রের প্রতি জামায়াতে ইসলামী বিশ্বাসী বলেই প্রতিটি সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে একটি বড় অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশ পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামী আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাস করে। বিগত দিনে সরকার পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহ.) ও তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (রহ.) ৩টি মন্ত্রণালয় পরিচালনা করে দেশের উন্নয়ন, সততা ও জবাবদিহিতার যে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনে করে, জনগণের সমর্থন বাদ দিয়ে ক্ষমতা দখলের অসুস্থ ও নেতিবাচক রাজনীতি, প্রতিপক্ষকে দমন, নির্লজ্জ দলীয়করণ, ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয়স্বার্থ চরিতার্থের মানসিকতাই দেশে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন,উন্নতি ও অগ্রগতির পথে প্রধান অন্তরায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অভাব সেই সংকটকে আরো তীব্র করে তুলছে। অনৈতিকতা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রেপ্রবেশ করেছে।প্রশ্নপত্র ফাঁস গোটা জাতিকে মেধাহীনতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা বিশ্বাস করি, মেধা ও নৈতিকতার সমন্বয় ব্যতিত তরুন প্রজন্মকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে একটি জনকল্যাণমূলক আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। জামায়াত সব সময় শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিরলসভাবে কাজ করছে আর্ত-মানবতার সেবায়। ইসলাম ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে প্রচলিত রাজনীতির বিপরীতে জামায়াত দুর্নীতিমুক্ত, আইনসম্মত, সুশৃঙ্খল, ভারসাম্যপূর্ণ, গতিশীল, বাস্তবধর্মী, দায়িত্বশীল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে, আলহামদুলিল্লাহ। জামায়াতে ইসলামী সব সময় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করে আসছে। তাই বিভক্তি বা বিভাজন নয়, বরং সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশার জনগণকে নিয়ে দেশপ্রেমের চেতনায় বলীয়ান হয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চাকে আরো বিকশিত করি। অর্থনৈতিক উন্নতি, ক্ষুধা-দরিদ্রতামুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধশালী কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করি।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী- বাংলাদেশের সবুজ জমিনে আল্লাহর দীন আল-ইসলামের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও সৎলোকের শাসন কায়েম করার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। সকল প্রতিকুলতার মাঝেও জামায়াত ধৈর্য এবং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল ও জনগণের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অপপ্রচার, অপবাদ, অনবরত নির্যাতন, হয়রানি চালিয়েও ইসলাম বিরোধী শক্তি ব্যর্থকাম হয়ে হিংস্রতা এবং উগ্রতার নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছে প্রতিনিয়ত। আমরা আশা করি, আপনারা সত্য ও সুন্দরের প্রিয় কাফেলা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবেন। অতীতের মতো আপনাদের দোয়া, ভালোবাসা ও সমর্থন অব্যাহত রাখবেন। আসুন, দলে দলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হয়ে কল্যাণ, মুক্তি ও সুন্দরের পথে এগিয়ে যাই। মহান আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল নেক আমল ও আল্লাহর পথে সকল প্রয়াস কবুল করুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।

মা’আসসালাম।

(মাওলানা আ.ন.ম. শামসুল ইসলাম) 
ভারপ্রাপ্ত আমীর
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।