২৩ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:২২

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন

প্রকল্প পরিচালকসহ পদস্থ কর্মকর্তারাই দায়ী

বাঁধ ভেঙে শতাধিক হাওর তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দায়ী। কাজের গুণগত মান নিশ্চিত করতে তেমন কোনো মনিটরিংও ছিল না। এমনকি যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ ঠিকাদারদের পুনরায় কাজ দেয়ার ঘটনা ঘটেছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সামগ্রিক এ ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালকসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না। এছাড়া বলা হয়, হাওর রক্ষাবাঁধ নির্র্মাণে যে নকশা করা হয়, সে অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন করা হয়নি। মার্চে অসময়ে হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। ১৯ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।


প্রসঙ্গত, ত্রুটিপূর্ণ বাঁধের কারণে এবং যথাসময়ে বাঁধ সংস্কার না করায় পানির তোড়ে একের পর এক বাঁধ ভেঙে হাওর অঞ্চলে স্মরণকালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এতে ওই অঞ্চলে উঠতি ফসলের নজিরবিহীন ক্ষতিসাধনসহ মাছ ও গবাদি পশুরও ক্ষতি হয়। বহু সাধারণ কৃষক-পরিবার একেবারে পথে বসে গেছে। এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে যুগান্তরে ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যেখানে তথ্যপ্রমাণসহ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি ও ফাঁকফোকর বেরিয়ে আসে। অবশেষে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও যার প্রমাণ মিলেছে।

এদিকে তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বলতে পারেন, অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে। মন্ত্রণালয় থেকেও যে পদক্ষেপ নেয়ার কথা, তাও নেয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’ সচিব বলেন, ‘আমরাও হাওরবাসীর ব্যথায় ব্যথিত।’

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন প্রকল্প পরিচালকের অধীনে ৬টি জেলা পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এ বিষয়ে বলা হয়, সুনামগঞ্জসহ ৬ জেলার হাওর অধ্যুষিত অঞ্চলে বর্তমানে তিনটি প্রশাসনিক বিভাগের (সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ) অন্তর্ভুক্ত। একটি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় একজন প্রকল্প পরিচালকের অধীনে যে কার্যক্রম পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়েছে, তা সঠিক হয়নি বলে বাস্তবে প্রমাণ মিলেছে। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ছোট ছোট প্রকল্প নিলে সুফল বেশি পাওয়া যাবে। সর্বোপরি হাওর অঞ্চলকে একটি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বন্যা প্রতিরোধসহ উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা অপরিহার্য। এক্ষেত্রে পার্বত্য জেলাগুলোর জন্য যেমন পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড আছে, তেমনি কার্যক্রম গ্রহণ হাওর এলাকায় জরুরি। হাওর ও জলাভূমি অধিদফতরের কার্যপরিধির মধ্যে এ ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত নয়। হাওর এলাকায় বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার, মেরামত ইত্যাদি কার্যক্রম ঠিকাদার বা পিআইসির লাভজনক কার্যক্রমের বাইরে এসে সেবামূলক কাজের মাধ্যমে এটি সম্পাদনের বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজের বেশির ভাগ বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলী বা এসওরা। কিন্তু এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাজের গুণগতমান ও কার্যক্রমের মনিটরিং ছিল না বললেই চলে। মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের ধীরগতিরোধ করা বা যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কিংবা প্রধান প্রকৌশলী বা প্রকল্প পরিচালক কেউ করেননি। বিশেষ করে ক্যারিডওভার (এক বছরে কাজ শেষ করতে না পারলে ঠিকাদারকে দ্বিতীয় বছর সুযোগ দেয়া) কাজ হাওর এলাকার জন্য মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি কোনো বিধিসম্মত পদক্ষেপও নয়। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান, কার্যাদেশ প্রদান এবং গুণগতমান বজায় রেখে প্রকল্পের কাজ সম্পন্নকরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কার্যাদেশোত্তর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজ বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। শতভাগ কাজ সম্পন্ন না হওয়া সত্ত্বেও দরপত্রের শর্ত মোতাবেক ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাফিলতির সাক্ষ্য বহন করে।

সুনামগঞ্জসহ হাওর এলাকায় আগাম বন্যা বা ঢল প্রতিরোধে বাঁধ মেরামত ও সংস্কারসংক্রান্ত মাটির কাজের যে কার্যক্রম, তা পুরো পানি উন্নয়ন বোর্ডের সমগ্র কাজের তুলনায় একটি অংশ মাত্র। সিলেট অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর নিয়ন্ত্রিত হাওর অঞ্চলের ছয় জেলার মাটির কাজ বাস্তবায়নে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। নিয়মিত মনিটরিং না করা, সময়মতো কাজ শুরু না করার বিষয়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ এই একটি অংশের কাজের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতো একটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সুনামের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। এই দায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠপর্যায়ের স্থানীয় কর্মকর্তারা ও প্রকল্প পরিচালক (সাময়িকভাবে বরখাস্ত আবদুল হাই) এড়িয়ে যেতে পারেন না। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যে তিনজন প্রকৌশলীকে (আবদুল হাই, নুরুল ইসলাম সরকার ও আফসার উদ্দিন) সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে, তা সময়োচিত পদক্ষেপ বলে ভুক্তভোগীরা আমলে নিয়েছেন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররাও এই ধীরগতি বা গাফিলতি বা কাজ না করার জন্য দায়ী। নীতিমালা অনুসরণ করে পিআইসি কমিটি গঠন করা হয় তা বাস্তবায়ন নিরিখে সংশোধযোগ্য। তদুপরি পিআইসি গঠনে বিলম্ব ঘটেছে। পুরো নীতিমালা পরীক্ষা করা প্রয়োজন এবং স্থানীয়ভাবে যে দাবি উঠেছে, ‘জমি যার বাঁধ তার’- তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অসময়ে হাওর অঞ্চলের কৃষকের ফসলহানি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামকে ব্যাপকভাবে ক্ষুন্ন করেছে। এই ঠিকাদার প্রক্রিয়াকে নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। হাওর এলাকায় ফসল রক্ষার কাজ স্থানের সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। সম্পূর্ণ কাজকে ভিন্নভাবে ও বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিতে বিবেচনার দাবি রাখে। স্থানীয় জনগণ ঠিকাদারি প্রথার পুরো বাতিল চেয়েছেন, যা প্রণিধানযোগ্য। স্থানীয় জনগণ উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ও জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে কাজটি সম্পাদিত হোক, এমন দাবি করেছে, যা বিবেচ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই দুর্যোগের কারণ একই সঙ্গে প্রকৃত ও মনুষ্যসৃষ্ট হতে পারে। কিন্তু সাধারণ বর্গাচাষী থেকে শুরু করে বহু জমির মালিক একবাক্যে পাউবোকে দোষারোপ করেছে। এবারের ফসলহানি ঘরে ঘরে সংকট ডেকে এনেছে। হাওরের কৃষকের মনের কথা প্রকাশ করতে তদন্ত কমিটি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে শিবাহী সাহা নামে এক গৃহবধূর কথা তুলে ধরা হয়। তদন্ত কমিটির সদস্যদের কাছে শিবাহী বলেন, ‘হাওরের একজন বউ আমি, আমার স্বামী কৃষক। আমাদের একটি মেয়ে আছে। আমার মতো আগাম বন্যায় হাজার হাজার কৃষক যখন বন্যায় ভাসে, তখন চোখের জল মানে না। সময়মতো বাঁধের কাজটি যদি পানি উন্নয়ন বোর্ড করত, তাহলে তাদের দোষারোপ কেউ করত না।’

তদন্তে প্রতীয়মান হয়, সুষ্ঠুভাবে ও সময়মতো ডিজাইন অনুসারে কাবিটা ও ঠিকাদারি কাজ সম্পন্ন হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজই শুরু হয়নি। তাই কেবল আগাম বন্যা ও বিপদসীমার ওপর পানি প্রবাহের কথা উল্লখ করে পুরো বিষয়টিকে আড়ালে নেয়া যায় না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠপর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা, স্থানীয় কৃষকদের কোনো আস্থাই অর্জন করতে পারেননি। স্থানীয়দের অভিমত, শয়তানখালি ক্লোজার না করার কারণে বিগত ২৩ ফেব্রুয়ারি ধর্মপাশার চন্দ্রসোনার থাল হাওরে পানি প্রবেশ করে।

এই আগাম বন্যা যে কোনো বছরই হতে পারে। তাই একজন সাধারণ কৃষক থেকে নদী গবেষক সবাই একবাক্যে বলেছেন : হাওর এলাকায় নদীসমূহ খননের কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে বিভিন্ন হাওরের তলদেশ ভরাট হওয়ার কারণে তাও খনন করা প্রয়োজন। এই খনন বিচ্ছিন্নভাবে করলে কোনো ফল আসবে না। উজান থেকে সংশ্লিষ্ট নদীগুলো খনন করলেই কেবল ইতিবাচক ফল আসবে।

বোরো ধানের বীজ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে যে বোরো ফসলের চাষ হয় তা পরিপক্ব হতে দীর্ঘ সময় নেয়। তাতে আগাম বন্যা বা ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। এই জুয়া খেলা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে প্রকৃতির বিরুদ্ধে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এককভাবে দায়িত্ব দিলে কাক্সিক্ষত ফল আসবে না। সে জন্য টেকসই বীজের উদ্ভাবন প্রয়োজন। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিতে পারে। তবে তাতে সময়ের দরকার হবে। এটি প্রণিধানযোগ্য যে, কৃষকদের স্থানীয় জাতের বা ট্রাডিশনাল জাতের বোরো ফসলে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টায় লাভ নেই। কারণ, এতে যে ফসল হয় তাতে খরচ উঠবে না। বিকল্প ফসলের ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট গবেষণা অপরিহার্য।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/06/23/134775/