২৩ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:২০

সড়ক-মহাসড়কে ভোগান্তির দায় পরিবহন মন্ত্রণালয়ের

সড়ক ও মহাসড়গুলোতে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ঈদে ঘরমুখো লাখ লাখ মানুষ। সঠিক সড়ক ব্যবস্থাপনা, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, বাসে বাড়তি ভাড়া আদায় রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া এবং যথাসময়ে সড়কের ভাঙাচোরা মেরামত না করায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় চরম ব্যর্থতায় পরিচয় দিয়েছে। সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট লেগে থাকছে। যাত্রীরা হাঁপিয়ে উঠছেন। বৃহস্পতিবার শেষ কর্মদিবসের পর লাখ লাখ মানুষ প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে ঢাকা ছাড়েন। কিন্তু পথে পথে তাদের যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর সেতু থেকে মেঘনা সেতু পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-আরিচা, আশুলিয়া-বাইপাইলসহ বিভিন্ন সড়ক ও মহাসড়কেও ছিল দীর্ঘ যানজট। অন্যদিকে টাঙ্গাইল, টঙ্গী, গাজীপুর, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া, ঢাকা-ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে অনেক এলাকায় সড়কের বেহাল অবস্থা। কোনো স্থানে সড়কে খানাখন্দে বৃষ্টির পানি জমে আছে। খানাখন্দে বাসের গতি হচ্ছে ধীর, বাড়ছে যানজটের বহর। এর প্রভাব পড়ছে বাসের সিডিউলের ওপরও। সড়ক ও মহাসড়কে যানজট থাকায় ঢাকায় সঠিক সময়ে বাস ঢুকতে পারছে না। ফলে নির্ধারিত সময়ে ঢাকা ছাড়ছে না অনেক পরিবহনের বাস। কাউন্টারে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন যাত্রীরা। যাত্রার শুরুতেই বাস পেতে ১-২ ঘণ্টা দেরি হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরের ব্যর্থতার মাশুল দিচ্ছেন যাত্রীরা। তারা সড়ক সংস্কারে শত শত কোটি টাকা ব্যয় এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
সিলেটের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন আবদুস সোবহান। মহাখালী বাস টার্মিনালে বৃহস্পতিবার দুপুরে সড়কের অবস্থা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ঈদে দুর্ভোগের শঙ্কায় সোমবার পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়েছি। তারা আমাকে জানিয়েছে, টঙ্গী থেকে পুবাইল পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ, দুর্ঘটনার আশঙ্কায় সবাই ভয়ে মুষড়ে পড়ে। বাস জোরে চালালে যাত্রীরা ড্রাইভারকে বকাবকি করেন। বাস আস্তে চলা ও পরে দীর্ঘ যানজটে পড়ায় নির্ধারিত সময়ের ৩ ঘণ্টা পরে তারা বাড়ি পৌঁছেছে। তিনি আরও বলেন, এখন গাড়ির চাপ বেশি। টঙ্গী থেকে ঘোড়াশাল পর্যন্ত সড়কটি অত্যন্ত সরু ও ভাঙাচোরা। কত ঘণ্টায় সিলেট যেতে পারব আল্লাহ জানেন।
সড়কে যানজটের ভোগান্তির বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি হাজী আবুল কালাম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, রাজশাহীর উদ্দেশে বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় একতা পরিবহনের গাড়ি ছেড়ে গেছে। দূরত্ব অনুযায়ী ওই রাত সাড়ে ৩টার মধ্যে গাড়ি পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু গাড়ি পৌঁছেছে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায়। একই অবস্থা অন্যান্য রুটেও। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার সকালে টাঙ্গাইলগামী বাসের প্রথম ট্রিপ ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে ছেড়েছে। যানজটের কারণে তা টাঙ্গাইল পৌঁছেছে বেলা সাড়ে ১১টায়। ভোরে রাস্তায় গাড়ির চাপ কম থাকার পরও লেগেছে দ্বিগুণ সময়। তিনি বলেন, সড়ক ভাঙাচোরা, বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল আদায়ে ধীরগতিসহ নানা কারণে ওই বাসের যাত্রীদের অতিরিক্ত ৬-৭ ঘণ্টা গাড়িতেই আটকা থাকতে হয়েছে। বেশি সময় গাড়ির ইঞ্জিন সচল থাকায় নষ্ট হয়েছে বাড়তি জ্বালানিও। তিনি আরও বলেন, ঢাকায় ফিরতেও যানজটে পড়তে হবে। তেলের খরচ তোলাই দায় হয়ে দাঁড়াবে পরিবহনের। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরও কয়েকজন বাস কোম্পানির মালিক। তারা জানান, যেসব বাস কোম্পানি আগাম টিকিট বিক্রি করেছে তারা গাড়ির সিডিউল ধরে রাখতে পারছেন না। প্রায় প্রতিটি গাড়ি আধ ঘণ্টা থেকে দেড়-দুই ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা ছাড়ছে।
রাজধানীর ভেতরেও বাস, লঞ্চ ও ট্রেন স্টেশনে পেঁৗঁছাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। রাজধানীতে সিএনজি চালিত অটোরিকশা মিটারে চলছে না। চালকের চাহিদা অনুযায়ী ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিসের নামে গলাকাটা ভাড়া আদায় চলছে। গণপরিবহনে এসব অনিয়ম বন্ধের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির। অথচ সংস্থাটির তেমন কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। ফলে পথে পথে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মো. আলী ইমরান অভিযোগ করে বলেন, মতিঝিল থেকে গাবতলী বাস টার্মিনাল যেতে বাসের সংকট। সিএনজি অটোরিকশায় যেতে চাইলে কেউ ভাড়া চায় ৫০০ টাকা আবার কেউ চায় ৫৫০ টাকা। কেউ মিটারে যেতে রাজি নয়, এমনকি মিটারের ভাড়া থেকে ৫০ টাকা বেশি দিতে চাইলেও রাজি হয়নি চালকেরা। তিনি বলেন, এ কোন দেশে বসবাস করছি। সিএনজি চালকেরা আইন মানে না, বিআরটিএও কোনো ব্যবস্থা নেয় না।
সড়ক ও মহাসড়কে অব্যবস্থাপনা, যাত্রীদের দুর্ভোগ-ভোগান্তি সম্পর্কে বক্তব্য জানতে বৃহস্পতিবার বিকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় যানজট পরিস্থিতি পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কারও কোনো অবহেলা, অনিয়ম ও দুর্নীতি সহ্য করা হবে না বলেও হুশিয়ারি দেন মন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, মহাসড়কগুলো যানজটমুক্ত রাখতে রাজধানী ও আশপাশের জেলায় তিনশ’রও বেশি আনসার সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএএন ছিদ্দিক বৃহস্পতিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, সড়কে যানজটের মাত্রা খুবই কম। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যানজট নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়া থেকে মেঘনা ব্রিজ পর্যন্ত গাড়ির চাপ রয়েছে। কারণ চার লেনের গাড়ি মেঘনা ও গোমতী ব্রিজে দুই লেনে পার হয়। দ্বিতীয় কাঁচপুর, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী ব্রিজ নির্মিত হলে এ মহাসড়কে যানজট থাকবে না। এছাড়া গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মিত হলে উত্তরবঙ্গের সড়কেও যানজট হবে না। বিগত বছরগুলোর থেকে এবার সড়কের অবস্থা অনেক ভালো বলেও দাবি করেন তিনি।
কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, বৃহস্পতিবার সরেজমিনে চন্দ্রা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ওই এলাকা লোকে লোকারণ্য। যাত্রীর তুলনায় পর্যাপ্ত বাস না থাকায় অনেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসের ছাদে চড়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। কোনো কোনো বাসের সিট পাওয়া গেলেও গুনতে হয়েছে বাড়তি ভাড়া। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিআরটিসির বাস পাননি এসব মানুষ। ভুক্তভোগীরা জানান, বিআরটিসির বাস না পাওয়ায় বেসরকারি বাসে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় যেতে ৪০০ টাকার ভাড়া ৬০০ টাকা, ৬০০ টাকার ভাড়া ৮০০ টাকা দাবি করছে বাসের কন্ডাকটাররা। শিল্পকারখানার শ্রমিক আকলিমা, ময়না ও লাভলী জানান, তাদের কারখানা ছুটি হয়েছে। তাই কষ্ট হলেও বাড়ি যাচ্ছেন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও বাস পাচ্ছেন না। যদিও বাস পাচ্ছে সিট মিলছে না। আবার ভাড়াও বেশি চাচ্ছে। এসব দেখার কেউ নেই।
সাভারের স্টাফ রিপোর্টার জানান, বৃহস্পতিবার সকালেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকামুখী রেডিও কলোনি থেকে সাভার বাজার বাস স্ট্যান্ড ও থানা বাস স্ট্যান্ড থেকে গেণ্ডা বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত তীব্র যানজট দেখা দেয়। এছাড়া ঢাকার বহির্মুখী আরিচা মহাসড়কের আমিনবাজার থেকে মধুমতি পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট ছিল। যানজটের কারণে বাস যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির কারণে কোথাও কোথাও খানাখন্দে পানি জমে। বাস চলাচলে দুর্ঘটনা এড়াতে চালক ধীর গতিতে গাড়ি চালান।
অন্যদিকে সকাল থেকেই বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যানজট সৃষ্টি হয়। এ মহাসড়কে শত শত যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। এ বিষয়ে সাভার ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ আবুল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের একাধিক টিম যানজট নিরসনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কাজ করে যাচ্ছে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/06/23/134777/