২৩ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১০

আনন্দ নেই হাওরে

ঈদের আনন্দ নেই হাওর এলাকায়। অকাল বন্যায় নিঃস্ব হওয়া হাওর বাসিন্দাদের বেশির ভাগই এবার বঞ্চিত হবেন ঈদ আনন্দ থেকে। ক্রেতাশূন্যতায় নদী ও হাওর পাড়ের দোকানিরা। মৌলভীবাজার জেলার হাওর ও নদী তীরবর্তী এলাকার হাট-বাজারের ব্যবসায় এখন বেহাল। স্থানীয় হাট-বাজারগুলোতে এ সময় জমজমাট বিকিকিনি হলেও এ বছর অন্য দৃশ্য। ঈদের বর্ণিল সাজে দোকানগুলো সাজালেও ক্রেতা কম। কারণ একটাই, এমন দুর্যোগের পর হাত খালি মানুষের। বোরো ধানের পর গেছে মাছ। এরপর হাঁস, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ। সবই গ্রাস করেছে উত্তাল হাওর। ভারি বর্ষণ আর উজানের পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট চৈত্রের অকাল বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব এ জেলার হাইল হাওর, কাউয়াদিঘি আর হাকালুকি হাওর পাড়ের মানুষ। মনু, ধলাই, ফানাই, সুনাই ও জুড়ী নদীর তীরবর্তী কয়েক লক্ষ মানুষের মধ্যে এখনো অধিকাংশ বাসিন্দা রয়েছেন পানিবন্দি। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য পরিবার বাঁচাতে যাদের দৌড়ঝাঁপ ঈদ বাজারের দিকে তারা কি আর খেয়াল রাখে। হাওর তীরের কৃষি ও মৎস্যজীবীরা জানালেন এ বছর যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে বৃষ্টি। গেল কয়দিনের টানা ভারি বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় তারা এখন ঘর বাড়ি হারা। তাই ঈদ এলেও তারা এখন চরম অসহায়। একদিকে হাতে নেই টাকা। অন্যদিকে গৃহহীন। তাদের ছেলে-মেয়েরা ঈদের নতুন জামা কাপড়ের আবদার করলে তারা শুধুই দু’চোখের জল ফেলছেন। বাজারের দোকানগুলোতে ঈদ উপলক্ষে দোকানিদের আয়োজনের কমতি নেই। কিন্তু স্থানীয় মানুষের সাধ্যটা কোথায়। দেশের সবচেয়ে বড় হাকালুকি হাওরের অকাল বন্যায় শতভাগ বোরো ফসল হারানো মানুষের আহাজারি থামেনি এখনো। দফায় দফয় ভারি বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢল সব কেড়ে নিয়েছে তাদের। স্থানীয় মানুষের এমন ক্ষয়ক্ষতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে হাওর ও নদী তীরবর্তী ছোট বড় বাজারগুলোর ঈদ বাজারে। প্রতি বছর রোজার প্রথম সপ্তাহ থেকেই কাপড়ের দোকানগুলোতে কেনাকাটার ধুম পড়ে। কিন্তু এবার পুরো জেলায় পরিলক্ষিত হচ্ছে ভিন্নচিত্র। দুর্যোগ মোকাবিলায় হিমশিম খাওয়া লোকজন পরিবারের খাওয়া বাঁচা নিয়ে দুশ্চিন্তায়। তাই আসছে ঈদের কেনাকাটায় খুব একটা আগ্রহ নেই তাদের। হাওর ও নদী তীরবর্তী কয়েকটি উপজেলার স্থানীয় বাজারগুলোর দোকানিরা জানান রমজানের প্রথম সপ্তাহ পর থেকে তাদের দোকান গুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় পরিলক্ষিত হতো, অথচ এবার যেন ঠিক বিপরীত চিত্র। বিক্রি ভালো না হওয়ায় তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। কারণ তারা ঈদ মৌসুমের কেনা-বেচা দিয়েই টিকিয়ে রাখেন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখনো আশানুরূপ ক্রেতারা দোকান গুলোতে না আসায় তারা পড়েছেন হতাশায়।

আগাম বন্যা কবলিত কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের মানুষের ঈদ আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। ঈদ দুয়ারে কড়া নাড়লেও সেখানে ঈদের আমেজ নেই। চরম অর্থকষ্টে দিন কাটছে হাওরের মানুষের। অর্থাভাবে বেশিরভাগ পরিবারেই এখনো কেনা হয়নি নতুন জামাকাপড়। হাওরে মাছ ধরে কেউ কেউ কোনরকমে জীবনধারণ করছেন। আবার অনেকেই জীবিকার তাগিদে ছেড়েছেন হাওরের নিজ গ্রাম। সেসব পরিবারের সদস্যরা গৃহকর্তার ফেরার আশায় দিন গুণছেন। ফলে দারিদ্রপীড়িত হাওরের মানুষের মাঝে ঈদ নিয়ে বাড়তি কোন উচ্ছ্বাস নেই।
স্থানীয়রা জানান, হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা মূলত একফসলী এলাকা। এখানকার একমাত্র ফসল বোরো ধান। চৈত্রের আগাম বন্যায় সেই বোরো ফসল হারিয়ে হাওরের কৃষক নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। অথচ সংসারের খোরাকি, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া, হাট-বাজার এমনকি বিয়েশাদিসহ উৎসব-পার্বণের সব খরচ নির্বাহ করা হতো বোরো ধান বিক্রির টাকা দিয়ে। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন বোরো ধান হারিয়ে কৃষকের মাঝে এখনো বিষাদের ছায়া। আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওরবাসীর যখন ঈদের আনন্দ উপভোগ করার কথা, তখন তারা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রাণান্ত সংগ্রামে ব্যস্ত। তাই ঈদ তাদের জীবনে খুশি বয়ে আনতে পারেনি।
ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউনিয়নের করণশী গ্রামের বর্গাচাষী আদম খাঁ (৫০) এবার ২ একর জমি করেছিলেন। জমি করতে গিয়ে মহাজনের কাছ থেকে দেড়ি সুদে ১৪ হাজার টাকা ছাড়াও একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তিনি। আগাম বন্যার পানিতে জমি তলিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আছেন মহাসংকটে। আদম খাঁ বললেন, ‘পানিতে খেত যাঅনে অহন বাইচ্যা থাহনের আশাডাও শেষ অইয়্যা গেছে। ঘরে খাঅনই নাই, হের ওপরে রেইনের চাপ। চাইট্টা মুখ যে কিতা দিয়া ভরমু, আল্লাঅই জানে। এর মাঝে আইতাছে ঈদ। ঈদ নিয়া চিন্তা করনের আর সুযোগ কই?’
করনশী পশ্চিপাড়ার কৃষক দুলাল মিয়া (৪৫) জানান, তিনি এক একর জমিতে বোরো ধান করেছিলেন। কিন্তু এক মুঠো ধানও ঘরে আনতে পারেননি। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে ছয় জনের সংসার চলছে অনাহার-অর্ধাহারে। যেদিন দিনমজুরির কাজ মিলে, সেদিন ঘরে চাল আসে। যেদিন মিলে না, সেদিন সবাই মিলে উপোস করতে হয়। দুলাল মিয়া বললেন, ‘খাইয়্যা বাঁচিনা, অহন পোলাপানরে ঈদঅ জামা-কাপড় দিমু কেমনে!’
করনশী পশ্চিপাড়ারই ইদ্রিছ মিয়া (৪৮) জানান, চার একর জমি করেও তিনি আজ নিঃস্ব। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মাছ ধরার জন্য জাল করেছেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার সাত জনের সংসার। খেয়ে-না খেয়ে থাকাই তার সংসারের এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে জানিয়ে ইদ্রিছ মিয়া বলেন, ‘এইরহম অভাব জীবনে অ দেখছি না। কেউট টাই যে গিয়া সাহায্য পাইমু, হেই অবস্থাও নাই। পোলাপাইনরে লইয়্যা চলন অই দায় অইয়া পড়ছে। ঈদের দিনঅ যে ঠিক মতন কাইতাম পারমু, হেইডা অই শিওর না।’
একই গ্রামের তোতা মিয়া (৫০) তিন একর জমি করে সর্বস্ব হারিয়েছেন। তিন ছেলে, এক মেয়ে আর ছেলের বউ নিয়ে তার আট জনের সংসার। বড় ছেলে গিয়াস উদ্দিন (২৫) জালে ওঠে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছেন। ঈদের কথা জিজ্ঞেস করতেই তোতা মিয়ার জবাব, ‘এই বার আর আমরার ঈদ নাই। পোলাপাইন ভাতের লাগি কান্দে। হেরারে ভাত অই দিতাম পারি না।’
কৃষক আজিজুর রহমান জানান, তিনি দেড় একর জমি করেছিলেন। সবই বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে চার জনের সংসারে এখন শুধুই অভাব। কয়েকদিন বর্শি দিয়ে মাছ শিকার করে সংসার চালিয়েছেন। কিন্তু এখন আর বর্শিতেও মাছ ধরে না। ঈদে ছোট ছেলেমেয়েদের নতুন কাপড় কিনে দেয়ার মতো সামর্থ্যও নাই। বললেন, ‘এই বছর পুরান কাপড় দিয়াই হগলের ঈদ করন লাগব।’
একই গ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, কেবল তার গ্রামে নয় হাওরের প্রতিটি গ্রামের মানুষেরই একই দুরবস্থা। তিনি সামর্থ্যবান কৃষক হলেও ঘরের মহিষ আর জমি বন্ধক দিয়ে কোনরকমে দিন পার করছেন। তিনি আরো জানান, হাওর পাড়ে এখন আর ধনী-গরিব বলে কিছু নেই। সবারই সমান আকাল দেখা দিয়েছে। ফলে হাওরবাসী অধিকাংশ পরিবারে ঈদের আনন্দ তো দূরের কথা ছোট ছেলে-মেয়েদের ছোটখাটো আবদার রাখার সামর্থ্যও আর নেই।
জয়সিদ্ধি বাজারের কাপড়ের ব্যবসায়ী জাবেদ ঠাকুর বলেন, ‘পানির সাথে ব্যবসাও গেছে গা। ঈদ দেইখ্যা দোকানঅ নতুন কাপড় তুলছিলাম। অইল বিহি-বাট্টা নাই। মানুষ কোন রহমে খাঅনের চিন্তা করতাছে। জামাকাপড় কিনার কোন বাও নাই।’

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=71285&cat=2/