২৩ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৯

মহাসড়কে ভয়ংকর লক্কড়ঝক্কড় বাস

ঢাকা মহানগর থেকে আশপাশের এলাকায় চলাচলরত ‘সিটিং সার্ভিস’ ও লোকাল বাসগুলোর বেশির ভাগই এবারও বেআইনিভাবে মহাসড়কে নামতে যাচ্ছে ঈদে ঘরমুখো যাত্রী পরিবহন করতে। পথ পরিবর্তন করে যাত্রী পরিবহনের জন্য এরই মধ্যে এ ধরনের কমপক্ষে ৪০ শতাংশ বাসের মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের পক্ষ থেকে এক ধরনের অলিখিত চুক্তি হয়ে গেছে।

ফিটনেসবিহীন এসব বাসের বেশির ভাগ চালকও অদক্ষ। তাদের অনেকেরই গাড়ি চালানোর বৈধ লাইসেন্স নেই। তবু এসব বাস যাত্রী টানবে দূরপথের। গত কয়েক দিন ঢাকার বিভিন্ন স্থান ঘুরে জানা গেছে, বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরাই মূলত এসব বাসের মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে ঈদে বাড়ি যেতে। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়, রংপুরের মতো দূরপথেও যাত্রী নিয়ে যাবে অভ্যন্তরীণ রুটের এসব বাস।
জানা গেছে, ঈদ সামনে রেখে ঢাকা ও বিভিন্ন জেলা থেকে অন্য জেলায় যাত্রী পরিবহনকারী বাস থেকে পথে পথে ‘বোনাস’ তুলতে তত্পর রয়েছে পুলিশ এবং পরিবহন খাতের চাঁদাবাজরা। বিআরটিএ, পুলিশ ও পরিবহন নেতাদের যোগসাজশে লোকাল বাসে এ চাঁদাবাজি হয়ে থাকে বিভিন্ন স্থানে।
সরকার লোকাল বাস মহাসড়কে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অনেক আগেই। ঢাকার বড় টার্মিনালগুলোতে রয়েছে এসংক্রান্ত তদারক কমিটিও। মোটরযান অধ্যাদেশ অনুসারে, পথ পরিবর্তন করে যাত্রী পরিবহন অবৈধ। তবে অনেক বাসচালক ও যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাহিদার তুলনায় গণপরিবহন কম থাকায় প্রতি ঈদে লোকাল বাস চলাচল করে থাকে মহাসড়কে। ফিটনেস না থাকায় লোকাল বাস মহাসড়কে নষ্ট হয়ে গিয়ে প্রতিবছর সৃষ্টি করে থাকে যানজট। অনেক ক্ষেত্রে লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনায় যাত্রীদের প্রাণ ঝরে যায়। এবার বর্ষণের কারণে মহাসড়কগুলো স্থানে স্থানে যান চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে। তার ওপর মহাসড়কে চলাচলের অনুপযুক্ত যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ছলিলদিয়ায় মাওয়া থেকে ভাঙ্গাগামী যাত্রীবাহী একটি লোকাল বাস (ফরিদপুর-ব-১২২) উল্টে দুজন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটেছে। ঈদ যাত্রার আগেই লোকাল বাসে এভাবে বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় প্রাণ ঝরছে।
বিআরটিএ, পরিবহন মালিক সমিতি ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরে আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির (আরটিসি) অনুমোদিত রুট আছে দুই শতাধিক। এসব রুটে চলাচলের জন্য নিবন্ধিত বাস ও মিনিবাস আছে প্রায় ১৩ হাজার। এর মধ্যে নিয়মিত চলাচল করছে প্রায় ছয় হাজার বাস। ঈদ সামনে রেখে ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটের এসব বাসের প্রায় ৪০ শতাংশই জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কে চালানোর জন্য মৌখিক চুক্তি করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে ঢাকার বিভিন্ন পথে চালানোর অনুমোদন নেওয়া হলেও এসব বাস চালানো হবে মহাসড়কে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া রুট পরিবর্তন করে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন বেআইনি। অভ্যন্তরীণ বাসগুলোর মহাসড়কে চলাচলের ক্ষেত্রে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। কিন্তু এসব না মেনে বেশি মুনাফার লোভে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা মহাসড়কে যাত্রী পরিবহন করতে জোর প্রস্তুতি নিয়েছে। গত কয়েক দিন রাজধানীর মিরপুর, গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, আবদুল্লাহপুরসহ বিভিন্ন প্রান্তে সিটিং ও লোকাল বাসের শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
গত বুধবার সকালে মিরপুর-২ নম্বর সেকশনের কমিশনার রোডের পাশে শিকড় পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-১৪০৭) দাঁড়ানো দেখে ভেতরে গেলে চালক জামিরুল ইসলাম ডালিম জানান, তাঁদের কম্পানির ৪০টি বাস মিরপুর-১২ থেকে যাত্রাবাড়ী পথে নিয়মিত চলাচল করে। ঈদে বাড়ি যাওয়ার এবং অনেক ক্ষেত্রে যাওয়া-আসার জন্য তাঁদের কম্পানিসহ বিভিন্ন কম্পানির বাস যাত্রী নিয়ে যায় ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ভৈরব, নরসিংদীসহ বিভিন্ন জেলায়। ২০ রমজানের পর এ ধরনের ট্রিপের জন্য চুক্তির হিড়িক পড়ে। দেখা গেল, শিকড় পরিবহনের ওই বাসটির বাম পাশের দুটো জানালার কাচ ভাঙা। জানতে চাইলে চালক জামিরুল বলেন, তাঁর কাছে কোনো লাইসেন্স নেই। ৪১ আসনের বাসটি চলে ১০১ নম্বর রুটে। এটি ঈদ মৌসুমে মহাসড়কে চলবে কি না জানতে চাইলে জামিরুল বলেন, ‘অন্যরাও যায়, আমরা গেলে সমস্যা কি?’
মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে সদরঘাট পথে চলাচলরত তানজিল পরিবহনের একটি বাসের চালক মো. রতন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিলেন বাস নিয়ে। ২৮ রমজানে একটি বাস ভাড়ায় ঢাকা থেকে রংপুর যেতে চুক্তি হয়েছে বলে তিনি জানান। রতন বলেন, ঢাকা থেকে রংপুর যেতে ৪০ হাজার টাকার চুক্তি হয়েছে।
দূরের গন্তব্যে যেতে ঢাকার লোকাল ও সিটিং সার্ভিসের ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসগুলো যাত্রীদের পক্ষ থেকে পছন্দ করা হয়ে থাকে বলে চালকরা জানিয়েছেন। ঢাকার এ/১৩১ নম্বর রুটে চলাচলকারী তানজিল পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-জ-১১-৩২০৬) চালক মো. সজীব জানান, ঢাকা থেকে রংপুর এক সপ্তাহের জন্য যেতে দুটো বাসের চুক্তি হয়েছে ৬৮ হাজার টাকায়।
মিরপুর-২ নম্বর সেকশনের কমিশনার রোডে বসুমতি ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো-ব-১১৭৪৩৭) মেরামতের জন্য থামিয়ে রাখা হয়েছিল। বাসে উঠে দেখা গেল, বায়ের লুকিং গ্লাসটি নেই। এটি চলাচল করে গাবতলী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পথে। জানা গেল, এটিও দূরপাল্লায় ভাড়ায় চালানো হবে। গতকাল শনিবার বিকেলে বাসটির চালক মো. শহীদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আগামী শুক্র ও শনিবার ঢাকা থেকে নেত্রকোনা ও মোহনগঞ্জ যাত্রী নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটো বাসের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তিনি জানান, ঢাকা থেকে এক দিনের জন্য বাসভাড়া নেত্রকোনার জন্য ২০ হাজার টাকা। বসুমতি কম্পানির বাসের বাইরেও অন্যান্য বাসের চুক্তি তার মাধ্যমে করানো যায়। গত বছরের মতো এবারও বিভিন্ন কম্পানির বাসের চুক্তি হচ্ছে।
মিরপুর লিংক লিমিটেড কম্পানির বাসগুলো চলাচল করে ইসিবি চত্বর থেকে আজিমপুর পথে। এটির পথ নম্বর ১২২। কমিশনার রোডে এ কম্পানির কিছু বাস দাঁড় করানো থাকে মেরামতের জন্য। এর মধ্যে একটি বাসে (নম্বর-ঢাকা মেট্রো-ব-১১৭৬০৩) উঠে গত বুধবার দেখা গেল, বাসের ফিটনেস বলতে কিছু নেই। বিভিন্ন অংশে গ্লাস ভাঙা। বাসচালক মো. ইসমাইল হোসেন, জানান, ঈদে দূরের পথে বাসের বডি ভাড়া একদিনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা। গত বছর রংপুর গিয়েছিলেন যাত্রী নিয়ে। এবার কম্পানির কিছু বাস দূরের পথে চালানোর জন্য চুক্তি হয়েছে। কয়েক দিন আগে কাউলা থেকে রংপুর যাওয়ার জন্য দুটো বাসের চালকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে রংপুর।
জাহিদুল ইসলাম শান্তি নামের এক ব্যক্তি জানান, মিরপুর লিংক লিমিটেড কম্পানিতে তাঁর ভাইয়ের ১০টি বাস আছে। এরই মধ্যে দুটো বাসের রংপুর যাওয়ার চুক্তি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঈদের জন্য আমাদের এসব গাড়ি আশপাশে চালানোর জন্য ছাড় দেয় প্রশাসন। যাত্রী বেশি থাকলে সিটিং বাসের ওপর চাপ পড়ে। এবার ছুটি দীর্ঘ। আগের বছরগুলোর মতো বেশি চাপ পড়বে না। ’
তেঁতুলিয়া পরিবহনের একটি বাস পল্লবীতে মূল সড়কের পাশে রেখে ভেতরে বসেছিলেন চালক আবদুর রহমান। তিনি জানান, শিয়া মসজিদ-আবদুল্লাহপুর পথে চলাচল করে তাঁদের কম্পানির ১১০টি গাড়ি। কয়েকটি বাস ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে যেতে চুক্তি হয়েছে। জানা গেল, এ কম্পানির বেশির ভাগ বাসের ফিটনেস নেই। চালকরাও দূরপাল্লায় বাস চালাতে অভ্যস্ত নন।
তেঁতুলিয়া পরিবহনের বাস চালান মো. জসীমউদ্দিন। তবে ইতিহাস পরিবহনের বাস নিয়ে গত বছর ঈদে নেত্রকোনা গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘অন্য জেলায় গেলে জিপির নামে চাঁদা দিতে হয়। গত বছর নেত্রকোনা গেলে আমার কাছে চাঁদাবাজরা দুই হাজার টাকা চেয়েছিল। ’ তিনি জানান, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, পঞ্চগড়, বগুড়াসহ বিভিন্ন জেলায় বাইরের ‘রিজার্ভ’ বাস দেখলেই চাঁদাবাজি শুরু হয়। এবারও এ প্রস্তুতি চলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, কাজলা, মাতুয়াইল, ডেমরা, জুরাইন, বাবুবাজার, কেরানীগঞ্জ, টঙ্গী, গাজীপুর, সাভার, নবীনগরসহ বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজে পুরনো বাস মেরামত করে নতুন রং দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন পরিবহন মালিক সমিতির তথ্যানুসারে, রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৫-২০ হাজার বাস চলাচল করে। ঈদ মৌসুমে যাত্রী বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফলে ঈদের তিন-চার দিন আগে থেকে লোকাল বাসও দূরপাল্লায় যাত্রী পরিবহন করে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীতে বাসের গতি খুব কম। মহাসড়কে দ্রুতগামী বাস ও অন্যান্য যানবাহনের সঙ্গে ঢাকা ও অন্যান্য স্থান থেকে লোকাল বা সিটিং বাস নামলে অদক্ষ চালকরা পেরে ওঠেন না। ফলে সড়কে প্রাণ বেশি ঝরে। আমরা এরই মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে ফিটনেসহীন বাস মহাসড়কে না চলতে দেওয়ার দাবিও সরকারের কাছে জানিয়েছি। ’
বিআরটিএর মিরপুর বিভাগের উপপরিচালক মো. মাসুদ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনুমোদিত রুট (পথ) পরিবর্তন করে এভাবে গাড়ি চালানো অপরাধ। আমরা এর আগেও এ ধরনের বাস কম্পানি কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছি। আমরা অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। ’

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/06/23/512031