ঈদের ছুটিতে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। সবার মধ্যে খুশির আমেজ। বুধবার কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রা শুরুর আগে ট্রেনের জানালায় হাস্যোজ্জ্বল এক নারী -যুগান্তর
২২ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৪

ট্রেন ও বিমান পরিবহনে বিপর্যয়

কমলাপুরে স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বিকল

কমলাপুর রেলস্টেশনের স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটিক) সংকেত ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ায় মঙ্গল ও বুধবার বেশকিছু ট্রেন বিলম্বে ছেড়েছে। উড়োজাহাজ সংকটের কারণে এ দু’দিন (মঙ্গল ও বুধবার) বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরীণ রুটের প্রায় সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। দু’দিনে তিনটি এয়ারক্রাফট বিকল হয়ে পড়ায় বিমানের অভ্যন্তরীণ রুটের সিডিউল ভেঙে পড়েছে। ফলে ঈদ উপলক্ষে ঘরে ফেরার শুরুতে চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছেন ট্রেন ও আকাশপথের যাত্রীরা। অবস্থার উন্নতি না হলে শেষ পর্যন্ত নাড়ির টানে গ্রামে ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে যাত্রীদের মাঝে শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাতিল ফ্লাইটের যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য শুক্রবার ঢাকা থেকে সব অভ্যন্তরীণ রুটে দুটি করে ফ্লাইট চালাবে বিমান।


বিমান সূত্রে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার জন্য বিমান দুটি ড্যাস-৮ উড়োজাহাজ দিয়ে সিডিউল তৈরি করেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার হঠাৎ করে ওই দুটি উড়োজাহাজ বিকল হয়ে পড়ে। বুধবার সকালে বিকল হয় ৭৭৭-২০০ বোয়িং। ট্রেনের পর বিমানের সিডিউল ভেঙে পড়ায় উভয় পথের হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগের শিকার হন। বিমানের জনসংযোগ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, বুধবার সকালের আগে উড়োজাহাজ দুটি মেরামত সম্ভব হবে এ আশায় যাত্রীদের জানানো হয়নি। এ অবস্থায় বুধবারও যাত্রীরা বিমানবন্দরে এসে আটকা পড়েন। দুর্ভোগের শিকার বিমান যাত্রীরা একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বিমান চেয়ারম্যান ও এমডির পদত্যাগ দাবি করে মিছিল করেন। এদিকে একের পর এক সংকেত ব্যবস্থা বিকলের ঘটনায় রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দুশ্চিন্তায় আছেন। এমন ঘটনায় বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলেও ধারণা করছেন রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা।

রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হাবিবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থাটি বিকল হয়ে যাওয়ায় নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভিডিও প্যানেলগুলো ব্লক ছিল মঙ্গলবার। তবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা তা দ্রুত সময়ের মধ্যেই মেরামত করেছেন। ব্লকের সময়টুকু ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে স্টেশনে ট্রেন প্রবেশ ও ছাড়তে নির্ধারিত সময়ের বেশি সময় লাগায় যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তিনি বলেন, এটি একটি স্বাভাবিক বিষয়, যান্ত্রিক ত্রুটি হতেই পারে। তার পরও বিষয়টি নিয়ে তারা বিশেষভাবে তদন্ত করছেন বলেও জানান তিনি।

কমলাপুর রেলওয়ে সিগন্যাল ও সংকেত বিভাগ-২-এর দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, মাইক্রোলক সিপিইউসহ ১৪টি কম্পিউটার মঙ্গলবার পরপর ৪ বার ব্লক হয়ে যায়। ফলে পুরো স্টেশনে সংকেত ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, তারা ১৪টি সুপার কম্পিউটারের মাধ্যমে কমলাপুর রেলস্টেশনের ১৭টি লাইন এবং ৪২টি ওয়ার্কিং পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করেন। পয়েন্ট সম্পূর্ণ করা না হলে কোনো ট্রেন যেমন কমলাপুরে প্রবেশ করতে পারে না তেমনি বেরও হতে পারে না। এর আগে গত মে মাসেও পরপর ৩ দিন কম্পিউটারগুলো ব্লক হয়ে পড়েছিল।

তিনি বলেন, ১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ সিস্টেমটি ইংল্যান্ডের ওয়েটিং হাউস নামক কোম্পানির সরঞ্জাম দিয়ে চালু ছিল। এর পর ২০১০ সালে ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের কোম্পানি এন-সালে¬া এসটিএস পুরো সিস্টেমটি পরিবর্তন করে তাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয়ার পরও ভারতীয় কোম্পানিটি তাদের লোক দিয়ে ২ বছর পরিচালনা করে। ওই সময় বেশ কয়েকবার ৪-৫ ঘণ্টা পুরো কম্পিউটার সিস্টেমটি ব্লক হয়ে যায়। ওই অবস্থায় ২০১২ সালে তাদের কাছে পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝিয়ে দেয়। এরপর থেকে প্রায়ই এ অবস্থায় সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

এদিকে ঈদ উপলক্ষে ঘরে ফেরার প্রথম দিন বুধবার কমলাপুর স্টেশনে তেমন ভিড় ছিল না। অধিকাংশ ট্রেন যথাসময়ে চলাচল করেছে। দেরিতে ছেড়েছে চারটি ট্রেন। রংপুর এক্সপ্রেস ভোর ৬টা ৫ মিনিটে কমলাপুর আসার নির্ধারিত সময় থাকলেও এসেছে সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে। ট্রেনটি প্রায় ২ ঘণ্টা বিলম্বে স্টেশন থেকে ছেড়ে গেছে। এছাড়া জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনটি দুপুর ১২টায় ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে ছেড়ে গেছে। একতা এক্সপ্রেস ৩৭ মিনিট বিলম্বে কমলাপুর ছেড়েছে। এছাড়া মঙ্গলবার স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বিকল হওয়ার কারণে ৭টি ট্রেন দেরিতে ছেড়ে গেছে। ওই ট্রেনগুলো বুধবার বিলম্বে ঢাকায় ফিরেছে।

মঙ্গলবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বিকলের ঘটনায় স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী যুগান্তরকে জানান, বুধবার যে ক’টি ট্রেন বিলম্বে চলাচল করেছে সেগুলো মূলত মঙ্গলবার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে বিলম্বে ছেড়েছে। বিলম্বে ছেড়ে যাওয়ায় বিলম্বেই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এসব ট্রেন পৌঁছে। তিনি বলেন, সংকেত ব্যবস্থা বিকল হওয়ার কারণে মঙ্গলবার কালনী এক্সপ্রেস, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস, এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস দেড় থেকে ২ ঘণ্টা বিলম্বে কমলাপুর থেকে ছেড়ে গেছে। বিলম্বে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বিলম্বে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবার থেকে এ সমস্যা থাকবে না বলেও তিনি জানান।

সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী সিরাজুল ইসলাম ও শিল্পী আক্তার দম্পতি জানান, দু’সন্তান নিয়ে বেলা ১১টায় কমলাপুর স্টেশনে এসে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করেন। দুপুর ১২টায় ট্রেন ছাড়ার কথা থাকলেও দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ছাড়েনি। রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রী মিজানুর রহমান জানান, সড়কপথে ঝামেলা এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে থাকার ভয়ে ১৭ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটেছেন। পরে ২ ঘণ্টা বিলম্বে ট্রেনটি কমলাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়। এদিকে স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বিকল হওয়ার ঘটনায় বিশেষ করে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিপাকে রয়েছেন। ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেছে সংশ্লিষ্টদের। ফের সংকেত ব্যবস্থা বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে এমনটাও আশঙ্কা করছেন তারা।

কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সিগন্যাল ও সংকেত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৩৭ মিনিট থেকে ৭টা ৫০ মিনিট, ৭টা ৫৫ মিনিট থেকে ৮টা ১৫ মিনিট, ৮টা ৩৬ মিনিট থেকে ৮টা ৫২ মিনিট এবং ৯টা ৩৩ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত ৪ ধাপে স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়ে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রেন অপারেশন কেবিনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা জানান, তাদের রুম থেকে কোনো সমস্যা হয়নি, মূলত সমস্যাটি হয়েছে সিগন্যাল রুম থেকে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ৪ বার তাদের ভিডিও প্যানেলটি ব্লক হয়ে যায়। ওই সময় কোনো ট্রেনেরই অবস্থান তারা জানতে পারেননি।

বিমানের অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট সিডিউল লণ্ডভণ্ড : লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছে বিমানের অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইট সিডিউল। ঈদে অভ্যন্তরীণ রুট পরিচালনার জন্য দুটি ড্যাস-৮ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট সিডিউল তৈরি করলেও রহস্যজনক কারণে দুটি উড়োজাহাজ বিকল হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে মঙ্গলবার সকালে একটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ এয়ারক্রাফটও সিলেটে বিকল হয়ে পড়ে। অপর বোয়িং ৭৭৭-২০০টি দীর্ঘদিন ধরে হ্যাঙ্গারে পড়ে আছে। এ কারণে বুধবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সৈয়দপুর, যশোর, বরিশাল ও রাজশাহী রুটের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। একইভাবে বাতিল করা হয় ওইসব রুটের ফিরতি ফ্লাইটগুলোও। এ অবস্থায় ঈদে ঘরমুখো যাত্রীরা বুধবার তীব্র ভোগান্তির মুখে পড়েন। বাতিল হওয়া ফ্লাইটের যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য শুক্রবার ঢাকা থেকে সব অভ্যন্তরীণ রুটে দুটি করে ফ্লাইট চালাবে বিমান। বিমানের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বুধবার একটি ড্যাস-৮ এয়ারক্রাফট সচল হয়। ওই এয়ারক্রাফট দিয়ে দুপুরে ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে একটি ফ্লাইট চালানো হয়। এছাড়া অন্য সব রুটের ফ্লাইট বাতিল করা হয়।

বিমানের অপারেশন শাখা সূত্রে জানা গেছে, বুধবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে আবুধাবি রুটে একটি ফ্লাইট পরিচালনার কথা ছিল। যে উড়োজাহাজ দিয়ে এ রুটটি পরিচালনার জন্য সিডিউল তৈরি করা হয়েছিল সকালে ওই এয়ারক্রাফটটি সিলেট গিয়ে বিকল হয়ে পড়ে। এ কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম-আবুধাবি ফ্লাইটটি বাতিল করা হয়। ঢাকা থেকে যাওয়া উড়োজাহাজটি সিলেটে গিয়ে বিকল হয়ে পড়ায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের কানেকটিং ফ্লাইটের সব যাত্রী আটকা পড়েন। এ অবস্থায় সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রীরা হইচই, চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু করেন। তারা বিমান চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) এনামুল বারী ও বিমান এমডি ক্যাপ্টেন (অব.) মোসাদ্দিক আহম্মেদের নামোল্লেখ করে অবিলম্বে তাদের পদত্যাগ দাবি করে স্লোগান দিতে থাকেন। একইভাবে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সৈয়দপুর ও যশোর বিমানবন্দরে শত শত যাত্রী আটকা পড়েন। তারাও বিমান বোর্ড ও বিমান ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবি করে মিছিল করেন ও স্লোগান দেন। একপর্যায়ে বিকালে সিলেট ও চট্টগ্রামের আটকা পড়া যাত্রীদের ফিরিয়ে আনার জন্য ৫টায় একটি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ সিলেটে পাঠানো হয়। বিমানের অপারেশন বিভাগ জানিয়েছে, ওই ফ্লাইটটি সিলেট থেকে যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রাম যাবে। এরপর চট্টগ্রাম থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকা এসে সরাসরি আবুধাবির উদ্দেশে রওনা হবে। এ কারণে আবুধাবি ফ্লাইটটি রি-সিডিউল করা হয়।

বিমানের জনসংযোগ শাখা সূত্রে জানা গেছে, আজ দ্বিতীয় ড্যাস-৮ উড়োজাহাজটি সচল হতে পারে। যদি উড়োজাহাজটি মেরামত সম্ভব হয় তাহলে আজকের অভ্যন্তরীণ রুটের সব ফ্লাইট যথাসময়ে ঢাকা ছেড়ে যাবে ও ফেরত আসবে। ফ্লাইট লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিতে কাল সবগুলো রুটে অতিরিক্ত করে একটি ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে। আজও রাজশাহী রুটে অতিরিক্ত একটি ফ্লাইট পরিচালণার কথা রয়েছে। প্রকৌশল শাখা সূত্রে জানা গেছে, তাদের একটি টিম বিকালের ফ্লাইটে সিলেট পৌঁছেছে। রাতের মধ্যে বিকল বোয়িং ৭৭৭-২০০ এয়ারক্রাফটটি মেরামত করা সম্ভব হবে।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/06/22/134522/