সরকার এবার প্রতি কেজি চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা দরে। এ অবস্থায় সরকারের খাদ্য সংগ্রহ অভিযানে অংশ নেয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বেশিরভাগ মিল মালিক। খাদ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের হিসাবে উত্তরাঞ্চলের চার জেলা দিনাজপুর, বগুড়া, নওগাঁ ও নাটোরের ৭০ শতাংশ মিল মালিক বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে চাল দিতে চুক্তিবদ্ধ হননি। মিল মালিকরা বলছেন, বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় চাল উৎপাদন খরচ পড়ছে বেশি। ফলে সরকারি দরে চাল দিলে তারা মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়বেন। তবে সরকার লাইসেন্স কেড়ে নিতে পারে এ ভয়ে লোকসান হলেও তারা চাল দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন চুক্তিবদ্ধ মিলাররা। ধান ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় মিলার-কৃষকরাই ধান মজুদ রেখেছেন। ফলে বাজারে ধান কম দেখা যাচ্ছে, যাও পাওয়া যাচ্ছে তার দাম অনেক বেশি।
দিনাজপুরে ছোট-বড় মিলিয়ে ২ হাজার ৪৯৪ মিল মালিকের মধ্যে এবার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছেন মাত্র ৬০০ জন। এছাড়া বগুড়ায় ১ হাজার ৯২৪ মিল মালিকের মধ্যে ৭০৭ জন, নওগাঁয় ১ হাজার ৮৮ মিল মালিকের মধ্যে ৪০৫ এবং নাটোরে ৫৩৭ মিল মালিকের মধ্যে চুক্তি করেছেন মাত্র ১০১ জন। ১ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চাল সংগ্রহ অভিযানে অংশ নিতে ২০ মের মধ্যে চুক্তি করতে মিল মালিকদের প্রতি আহ্বান জানায় সরকার। তবে ধানের বাজার মূল্য বেশি এবং এর জেরে প্রতি কেজি চালে তাদের লোকসান গুনতে হবে জানিয়ে মিলাররা এ চুক্তি থেকে বিরত থাকেন। এরপর খাদ্য বিভাগ চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য ৩১ মে পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, একাধিকবার আহ্বান জানানোর পরও যারা সাড়া দেননি, আগামী চার মৌসুম তাদের কাছ থেকে চাল কিনবে না সরকার। বাতিল হতে পারে মিলের লাইসেন্সও। বিস্তারিত যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবরে-
দিনাজপুর : জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম কায়ছার আলী জানান, সরকারি খাদ্য সংগ্রহ অভিযানে ব্যাঘাত সৃষ্টির দায়ে চুক্তি না করা মিলারদের ৪ মৌসুমের জন্য নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হতে পারে। খাদ্য অধিদফতর থেকে তাদের লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশনা আসার ইঙ্গিত দেন তিনি। আর লাইসেন্স বাতিল হলে তাদের ব্যাংক ঋণও বাতিল হবে। জেলা খাদ্য বিভাগ জানায়, চলতি অভিযানে দিনাজপুরে ৮৬ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ৬০০ মিল মালিক ৩০ হাজার টন চাল সরবরাহের চুক্তি করেন। কিন্তু ২ মে থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত এখানে চাল সংগ্রহ হয় মাত্র ৫ হাজার ৫০০ টন। এতে বোরো সংগ্রহ অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মিল মালিকরা বলছেন, সরকার এবার প্রতি কেজি চালের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩৪ টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকা দরে। ফলে সরকারি শর্তে এ অভিযানে অংশ নিলে তাদের কঠিন লোকসানের মুখে পড়তে হবে। বাজারে ধানের দাম বেশি হওয়ায় চালের উৎপাদন খরচও বেড়েছে বলে তারা জানান।
মিল ব্যবসায়ী সলিলেশ্বর বসাক জানান, এক বস্তা ধান থেকে চাল উৎপাদন হয় ৪২ থেকে ৪৩ কেজি। এতে ধানের দাম, পরিবহন ও উৎপাদন খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি মোটা চাল উৎপাদন করতে ৪০ থেকে ৪২ টাকা পড়ে যায়। এ অবস্থায় সরকারি ৩৪ টাকা মূল্যে চাল সরবরাহ করা তাদের জন্য দুষ্কর।
নওগাঁ : ধান উৎপাদনকে কেন্দ্র করে জেলায় প্রায় ১ হাজার ৮৮টি চালকল গড়ে উঠেছে। দেশের সবচেয়ে বড় চালের মোকামও এটি। এ চালকলগুলো থেকে প্রতি বছর উৎপাদিত ১৬ লাখ টনের মধ্যে সারা দেশে ১২ লাখ টন সরবরাহ হয়ে থাকে। তবে এবার সরকারের চাল সংগ্রহ অভিযানে সাড়া দেননি এখানকার ৬৮৩ মিল মালিক। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আবদুস সালাম জানান, যারা সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেননি চার মৌসুম সরকার তাদের কাছ থেকে চাল কিনবে না। আর চুক্তিবদ্ধ মালিকরা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হন, জামানত বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি পরবর্তী দুই মৌসুম তাদের কাছ থেকে চাল কিনবে না সরকার।
খাদ্য বিভাগ জানায়, এবার নওগাঁয় ৩৪ টাকা কেজি দরে ৪২ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ সংগ্রহ অভিযান চলবে ১ মে থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সংগ্রহের শুরুতেই খোলাবাজারে চালের দাম বেড়ে যায়। আর ধান ও চালের বাজারমূল্য বেশি এবং প্রতি কেজিতে আড়াই থেকে ৩ টাকা লোকসান গুনতে হওয়ায় চুক্তি থেকে বিরত থাকেন মিলাররা। পরে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার জন্য সময় ৩১ মে পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। জেলায় বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির ধান। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নেকব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্জিত হয়েছে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমির ধান। অপরদিকে, খাদ্য গুদামে চাল না আসায় শুয়ে-বসে অলস সময় পার করছেন জেলা খাদ্য গুদামসহ ১১টি উপজেলার ৬ শতাধিক শ্রমিক। কাজ না থাকায় ঈদ ঘিরে দুশ্চিন্তা বেড়েছে তাদের।
বগুড়া : জেলার খাদ্য-উদ্বৃত্ত উপজেলা আদমদীঘিতে সংগ্রহ অভিযান মুখ থুবড়ে পড়ায় সরকারি খাদ্য গুদামগুলোতে মজুদ শূন্যের পথে। প্রায় দেড় লাখ টন ধারণ ক্ষমতার সাইলো, সিএসডি ও এলএসডিতে এখন খাদ্যশস্য মজুদ আছে মাত্র ৭ হাজার ৮২৭ টন। এ নিয়ে শুধু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নন; উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষও। সোমবার পর্যন্ত সান্তাহার সিএসডির মজুদ ছিল আমন-বোরো মিলে এক হাজার ১৯৫ টন। সাড়ে ১২ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার তিন এলএসডিতে মজুদ আছে এক হাজার ৬০২ টন। দেশের একমাত্র মাল্টিস্টোরিড ওয়্যার হাউসে (সান্তাহার রাইস সাইলো নামে পরিচিত) মজুদ চালের পরিমাণ মাত্র ৬৩০ টন এবং সান্তাহার খাদ্যশস্য সাইলোতে (গম সংরক্ষণাগার) সোমবার পর্যন্ত মজুদ ৪ হাজার ৪০০ টন ছিল বলে জানান ওই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইলিয়াছ হোসেন। ইলিয়াছ হোসেন আরও জানান, এবার সংগ্রহ অভিযান সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় খাদ্যশস্যের মজুদ অনেক কমে গেছে।
নাটোর : জেলার সাত উপজেলার চাল কল মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে এবার মোট ১৩ হাজার ৮২ টন চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। জেলায় তালিকাভুক্ত ৫৩৭টি চাল মিল থাকলেও এবার চুক্তি করেছে মাত্র ১০১টি। চুক্তিবদ্ধ মিলের কাছ থেকে এবার চাল পাওয়ার কথা ৪ হাজার ১৭৭ টন। তবে ২ মে থেকে শুরু হওয়া এ সংগ্রহ অভিযানে এ পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪শ’ টন। কৃষকরা জানান, এবার অসময়ের অতি বৃষ্টি এবং পোকার আক্রমণে নাটোর অঞ্চলে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এতে চালের উৎপাদন কমে গেছে। ধান ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের অন্য জেলায় ধান-চালের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে এ এলাকার ধান অন্য জেলায় চলে গেছে। এছাড়াও নাটোরের বড় বড় অটো রাইস মিল এবং বয়লার সারা মৌসুম চালু রাখার স্বার্থে ওইসব মিল মালিক নিজেরাই তাদের গুদামে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ধান সংগ্রহ করে রেখেছেন। পাশাপাশি বাজারে চালের দাম বেশি থাকায় বাড়ির গোলাতে পর্যাপ্ত ধান মজুদ রেখেছেন কৃষক। এসব কারণে বড় বড় হাটে ধানের সরবরাহ একদমই কমে গেছে এবং যাও পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম অনেক বেশি। ফলে গত বছর এ জেলায় ১৬ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ অর্জিত হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ১০ ভাগও অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।