২২ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৫

সিন্ডিকেট কি সরকারের চাইতেও শক্তিশালী

বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের উন্নতি হয়েছে, কিন্তু এর কার্যকর সুফল পাচ্ছে না রোগীরা। এ নিয়ে ১৭ জুন একটি প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। প্রতিবেদনে বলা হয়, আগ্রাসী ওষুধ বাণিজ্যের কারণে ক্রেতাস্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। ওষুধের দাম, মান ও কার্যকারিতা সম্পর্কে গণমাধ্যমে প্রচারের সুযোগ না থাকায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এখন মুনাফার বাহন হয়ে উঠেছে। আমরা জানি, অসুখে-বিসুখে সাধারণ মানুষ ফার্মেসি এবং ডাক্তারের ওপরই নির্ভর করে থাকে। অথচ ওষুধ সম্পর্কে নিজেদের জানার কোন সুযোগই নেই। উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকেন। আর ডাক্তার এবং ফার্মেসির ওপর ভরসা রেখেই যেন চলছে বাংলাদেশের ওষুধ বাণিজ্য। কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান এবং দেশের বাজারে ৯৭ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে রফতানি খাতেও অবদান রাখছে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প। তবে দুঃখের বিষয় হলো, এই শিল্পটি জনসচেতনতায় কোন ভূমিকা রাখতে সমর্থ হচ্ছে না। নিজস্ব ওষুধের উপাদান এবং কার্যকারিতা নিয়ে কোন প্রচার না থাকায় সাধারণ ক্রেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন ওষুধের পরিবর্তে নি¤œমানের ও নকল ওষুধ ব্যবহার করে আরোগ্য লাভের পরিবর্তে স্বাস্থ্যগত জটিলতায় পড়ছেন। ওষুধ শিল্পমালিক সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি ওষুধ নীতির বাধ্যবাধকতার কারণে তারা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে তাদের কোন প্রোডাক্ট সম্পর্কে ক্রেতাদের জানাতে পারছেন না। ফলে মানুষ নকল ওষুধ ও নিম্নমানের ওষুধ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। সাধারণ ক্রেতারা বুঝতে পারেন না কোন ওষুধ তারা কিনবেন কিংবা কোন্্টা কেনা উচিত নয়। এ সুযোগে অসাধু চক্র মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও লেবেল পাল্টে বাজারে বিক্রি করছে। কার্যকর তদারকির অভাবে এ অনৈতিক বাণিজ্য ঠেকানো যাচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপন বাজারে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রচার কার্যক্রম লক্ষ্য করা গেছে, কিন্তু এতে ওষুধ শিল্পের কোন অবদান নেই। অথচ ডাক্তারদের ব্যবস্থাপত্রে নিজেদের কোম্পানির ওষুধের নাম লেখানোর জন্য তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকে। কোন কোন ওষুধ কোম্পানি ডাক্তারের চেম্বারে ও বাসায় ফ্রিজ, এসি, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন উপঢৌকন পাঠিয়ে নিজেদের আস্থায় রাখার চেষ্টা করেন। ডাক্তারদের বিদেশ ভ্রমণের রসদও জোগান দেয়া হয়। এমনকি ফ্ল্যাট ও বাড়ি কিনে দেয়ার কথাও চালু রয়েছে ওষুধ কোম্পানির টাকায়। গত ৪ বছরে ৫০টির বেশি নতুন ওষুধ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে দেশে। ওষুধের রফতানি বাজারও বাড়ছে প্রতি বছরই।
আমেরিকা, ইউরোপসহ বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর দেশগুলোতেও বাংলাদেশের ওষুধের বাজার সৃষ্টি হচ্ছে। এটি দেশের জন্য ভালো খবর। কিন্তু দেশের বহু মানুষ সঠিক ওষুধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই নকল ও নিম্নমানের ওষুধের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। এ জন্য তদারকির পাশাপাশি প্রয়োজন যথাযথ প্রচারণাও। কিন্তু ওষুধ নীতির বাধ্যবাধকতার কারণে ওষুধের মান ও কার্যকারিতার বিষয়গুলো প্রচার করা যাচ্ছে না। তাই এই প্রতিবন্ধকতাটি তুলে নেয়ার দাবি উঠেছে। ওষুধ সম্পর্কে ক্রেতাদের জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে ওষুধ নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে না। কনজুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান জানান, দেশের প্রায় ১০ শতাংশ ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করছে। আর কিছু নীতিহীন চিকিৎসক অর্থলিপ্সার কারণে ব্যবস্থাপত্রে নিম্নমানের ওষুধের নাম লিখছেন। ক্রেতা স্বার্থে এসব বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বন্ধ হবে কী?
প্রসঙ্গত উঠে এসেছে সিন্ডিকেটের কথা। সম্প্রতি ‘সব কিছুতেই সিন্ডিকেট’ শিরোনামে একটি খবর মুদ্রিত হয়েছে পত্রিকান্তরে। ১৮ জুন প্রকাশিত খবরটিতে বলা হয়, এখন সময় সিন্ডিকেটের, সর্বত্রই চলছে সিন্ডিকেট সা¤্রাজ্যের দৌরাত্ম্য। সরকারি দফতর-অধিদফতর থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, তদবির, গ্রুপিং-লবিং এমনকি অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেটের বিকল্প নেই। সমমনা নেতা কর্মীদের নিয়ে যেমন সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে; তেমনি ধান্ধাবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুটপাট চালাতে সরকারি আর বিরোধী দলের নেতারাও মিলেমিশে তৈরি করেন সিন্ডিকেট। সরকারি দফতর-অধিদফতর থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট সদস্যরা গ্রুপিং সেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে যা খুশি তা করে বেড়ান। তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলে ঘুষ-দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি অপরাধ-অপকর্ম ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাবশালী কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে দেশে, যাদের কাছে অনেক সময় সরকারও অসহায় হয়ে পড়ে। প্রতি বছর রমযানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার সরকারি উদ্যোগ-আয়োজন সবকিছু এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভণ্ডুল হয়ে যায়।
সিন্ডিকেট সাম্রাজ্য এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। আইন-আদালত ঘিরেও রয়েছে আরেক সিন্ডিকেট। ন্যায়নীতির বুলি আউড়িয়ে অভিজাত পোশাক ধারণ করে তারা আইনি জটিলতা তৈরি করে জনহিতকর কর্মকাণ্ডে বাধ সাধেন। স্বার্থ হাসিল করতে সবকিছুই করতে পারে সিন্ডিকেট। রাজনৈতিক দলের মনোনয়নপ্রাপ্তি থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি হতে হলেও সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ অপরিহার্য। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের মধ্যে যেমন আলাদা সিন্ডিকেট আছে। তেমনি সংসদ সদস্যদের মধ্যেও আছে আলাদা মত-পথের সিন্ডিকেট জেলা পর্যায়ে ও সংসদ সদস্যরা পৃথক সিন্ডিকেটে বিভক্ত। এছাড়া মানব পাচার জনশক্তি রফতানি এমনকি হজ্বে লোক পাঠানোর বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছে শক্তিশালী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট সদস্যদের প্রভাবেই দেশজুড়ে দখল-বেদখল-পাল্টা দখলের সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। ক্ষমতার প্রভাব, দলীয় পরিচয়, অস্ত্রশক্তি আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কারো কারো সহযোগিতা নিয়ে চলে দখলবাজির দাপুটে কারবার।
সিন্ডিকেটের শক্তি ও দাপট নিয়ে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে তা খুবই ভয়ংকর। সিন্ডিকেট সদস্যদের নিজেদের স্বার্থই শেষ কথা। দেশ-জাতি-জনগণ তাদের কাছে তুচ্ছ বিষয়। দলের লেবেল ও তাদের একটি কৌশল বৈ আর কিছু নয়। তাই বলতে হয়, নীতি-নৈতিকতা বর্জিত এই সিন্ডিকেট চক্র দেশ ও জাতির জন্য এক বড় আপদ। এই বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পরও তাদের প্রসার তো কমছে না।
আমরা মনে করি, একমাত্র সরকারই তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আইনকে তাদের ক্ষেত্রে কার্যকর করা গেলে তাদের দম্ভ চূর্ণ হতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা এখানেই। তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না বা আনা যাচ্ছে না। তাই প্রশ্ন জাগে, সিন্ডিকেট চক্র কি দেশের সরকারের চাইতেও শক্তিশালী? আমরা তা মনে করি না। ওদের নিয়ন্ত্রণে সরকার এগিয়ে এলে জনগণও সহযোগিতার হাত বাড়াবে।

http://www.dailysangram.com/post/289112-