|| মাসুদ মজুমদার ||
ক. রাঙ্গামাটির পথে রাঙ্গুনিয়ায় মির্জা ফখরুলের ত্রাণবাহী গাড়িবহরে হামলার পর সরকারি মহলে প্রতিক্রিয়া দুঃখজনক ও দুশ্চিন্তার। মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের বক্তব্য দুর্বোধ্য এবং রহস্যজনক। আইনি পদক্ষেপের বিষয়টি হতাশাজনক। সম্ভবত ৮৩ মামলার আসামি প্রতিপক্ষের শক্তিশালী মুখপাত্রকে হামলার মাধ্যমে ‘খামোশ’ করে দেয়ার উদ্দেশ্যটাই ছিল মুখ্য। এই হামলায় আরো মর্মান্তিক কিছু ঘটে যাওয়ার সম্ভাবনাও ছিল প্রবল।
কয়েকটি ঘটনা প্রমাণ করে, সরকারি দল বিজয়ের নিশ্চয়তা না পেলে ‘তৃতীয় পক্ষের’ কাছে যে কোনোভাবেই ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে হলেও বিএনপি জোটকে ঠেকাতে চেষ্টা করবে। নয়তো নির্বাচনের জন্য ভোট চাওয়ার বিপরীতে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের এমন কারণ ঘটানো হতো না।
রাজনীতিতে এ ধরনের হামলা কোনোকালে নন্দিত হয়নি। বরং ভোটের রাজনীতিতে এ ধরনের ন্যক্কারজনক হামলা পতনকে অনিবার্য করেছে। জনসমর্থনকে শূন্যের কোঠায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে। একধরনের মমত্ববোধ আক্রান্তরাই পেয়ে যায়।
এই মন্তব্য রূঢ় এবং প্রান্তিক। এরপরও স্পষ্ট, বিনা উসকানিতে লাঠি নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ত্রাণবাহী গাড়িবহরে আক্রমণ চালানোর সাহস পেত না। ঘটনার জন্য দায়ীদের ছাড় দেয়া হবে নাÑ এ ধরনের ঘোষণা সরকার পক্ষ থেকে এলেও, হামলার ঘটনায় কেউ আটক না হওয়ার পর অনুসিদ্ধান্ত একটাইÑ উসকানিটা ওপর তলার, স্থানীয়দের নয়। স্থানীয়রা লাঠিয়াল মাত্র। জেনে বুঝেই মির্জা ফখরুল ও আমীর খসরু মাহমুদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। সম্ভবত এটা পরিকল্পিত টার্গেট।
মির্জা ফখরুল ভুঁইফোঁড় মানুষ নন, আমীর খসরু মাহমুদও যুক্তিবাদী এবং তুখোড় মানুষ। এরা দু’জনই জাতির কাছে চেনা মুখ, পরিমিতিবোধ সম্পন্ন ও পরিশীলিত মানুষ হিসেবে পরিচিত। তাদের টার্গেট করার আগে নিশ্চয় ভাবতে হয়েছে জাতির কাছে কী বার্তা যাবে। সেই অসুখকর বার্তা উপেক্ষা করে হাছান মাহমুদের ‘উত্তেজিত জনতার’ চেহারা সুরত জানা খুবই জরুরি। হাছান মাহমুদ খুব একটা নন্দিত রাজনীতিবিদ কি না, জানা নেই। তবে দলীয় নেতা হিসেবে তিনি নিজের ওজনের চেয়ে ভারী বক্তব্য দিয়ে প্রায় ওপরের দিকে থুথু ছিটান, শেষ পর্যন্ত নিজের গায়ে মাখেন।
মির্জা ফখরুল সব বিরোধী দলের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মানুষ। তার প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদেরাও তাকে সমীহ করার পক্ষে। তার রাজনীতির ‘নীতি’ সমর্থনের বিষয় নয়, বিষয়টি একজন নিপাট ভদ্রলোকের প্রতি এক ধরনের মানসিক শ্রদ্ধা। ৮৩ মামলা নিয়ে যিনি সতত সক্রিয়, তাকে হামলা না করে থামানোর উপায় কী! এই যদি মানসিকতা হয়, তাহলে জাতি ধরে নিতে বাধ্য আওয়ামী লীগের যুক্তির ভাষা একেবারে ফুরিয়ে গেছে। এখন শক্তির বিকল্প নেই। তাই খালেদার অফিসে তল্লাশি, মওদুদের বিরুদ্ধে হয়রানির ব্যবস্থা, জনসভা করতে না দেয়া, ঘরে ঘরে তল্লাশি এবং ন্যূনতম কর্মসূচি পালনে বাধা। সরকারি দল যদি খানিকটাও ছাড় না দেয় তাহলে নির্বাচন কিভাবে হবে! বিশদলীয় জোটকে এড়িয়ে ভোট গ্রহণযোগ্য করার কোনো দাওয়াই এখন আর নেই।
মির্জা ফখরুলদের ওপর রাঙ্গুনিয়ার হামলাটি রীতিমতো অভাবনীয়, অচিন্তনীয় ও উৎকণ্ঠার। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এভাবে দমিয়ে দিতে চাইলে গণতন্ত্র চর্চার রেশটুকুও থাকে না। তাই আশঙ্কা করি সম্ভবত আওয়ামী লীগ ভোট চায় না বলেই ভোটের আগাম জিগির তুলছে। বাস্তবে দেশে গণতন্ত্র যেন এখন মির্জা ফখরুলের উদোম শরীর।
খ. আগামীকাল ২৩ জুন, ২০১৭। পলাশী বিপর্যয়ের ২৬০তম দিন। পলাশী বিপর্যয় বা ট্র্যাজেডি একটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা নয়; ইতিহাসের বাঁক ঘুরানো একটি দিন। উপমহাদেশের ইতিহাসে তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী একটি দিন। ইতিহাসের সব ঘটনা-দুর্ঘটনাই অনাগত ভবিষ্যতের জন্য প্রভাব রেখে যায়। কোনো কোনো ইতিহাস আছে মানবগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত ভাবায়। বারবার পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে। সেই ইতিহাসকে বর্তমানের নিরিখে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়। ভবিষ্যতের পথ রচনায় সেই ইতিহাস হয়ে ওঠে বিশ্লেষণের অনিবার্য উপাদান।
পলাশী ট্র্যাজেডি আমাদের জাতিসত্তার সাথে লেপ্টে থাকা সেই দিন, যে দিনটিকে সামনে রেখে হৃদয়ের অবিরত রক্তক্ষরণের মাঝেও আমরা শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার প্রেরণা পাই। সেই শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বলে উঠতে পারিÑ আর কোনো পলাশী নয়। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে এটুকু অর্জন আমাদের অধিকার।
পলাশী শুধু ভাগীরথী নদীর তীরে এক ফালি জমি নয়, যুদ্ধ মহড়ার স্থান নয়, পলাশী স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের অহঙ্কারের স্থান, ইতিহাসের তীর্থভূমি। আপসহীন লড়াকু মানুষের চোখে কারবালার শিক্ষা যেমন প্রতিটি ভুঁই কারবালাÑ আর প্রতিদিন আশুরা; তেমনি স্বাধীনতাকামী মানুষের হৃদয়পটে পলাশী মানে স্বাধীনতার সতত আকাক্সা, প্রতিনিয়ত বিশ্বাসঘাতকতার মোকাবেলায় স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার।
পলাশী চিহ্নিত করেছিল বিশ্বাসঘাতকতার স্বরূপ, স্বাধীনতার প্রতীক। তাই, ইতিহাসের মহানায়ক নবাব সিরাজউদ্দৌলা আর স্বাধীনতা যেন একার্থবোধক। মীরজাফর, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, ঊমি চাঁদ, ঘসেটি বেগম, জগৎশেঠেরা বিশ্বাসঘাতকের প্রতীক। এগুলো শুধু কোনো নাম নয়, নামের আড়ালে ইতিহাস চিহ্নিত অভিধাপ্রাপ্ত এবং অভিযুক্ত প্রতীকী খেতাব। এ কারণেই আমরা সময়ের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি ঘটনায় ও প্রতি মুহূর্তে চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করি সত্য ও স্বাধীনতার প্রতীক সিরাজকে, আর প্রতিপক্ষের চিহ্নিত করি বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক মীরজাফরকে।
পলাশী শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করার সুযোগ দিয়েছিল বলেই আজ খল চরিত্রের এনজিও, পঞ্চম বাহিনীর অপতৎপরতা, বেনিয়াচক্রের অশুভ ছায়াপাত, বিদেশী শক্তির কূটচাল ও আধিপত্যকামীদের প্রতিটি পদক্ষেপে আমরা টের পেয়ে যাই, বোধ করি আরেকটি পলাশী ট্র্যাজেডি ধেয়ে আসছে। স্বাধীনতা ও বিশ্বাসঘাতকতাকে পরিমাপযোগ্য করার জন্য পলাশী আমাদের জাগ্রত রাখে ও সম্বিত ফিরিয়ে দেয়। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্য মীর কাশিমের মতো রুখে দাঁড়াবার সাহস জোগায়। তিতুমীর, মজনু শাহ, হাবিলদার রজব আলী, শরিয়তুল্লাহর মতো ঝলসে ওঠার প্রেরণা এসে বাহুতে ভর করে। তাই, শোকাবহ পলাশী আমাদের ‘হায় পলাশী বলে’ শুধু মাতম করতে উৎসাহিত করে না। আর কোনো পলাশী নয়Ñ এ সেøাগান উচ্চকিত করে বুক টান করে স্বাধীনতার সপক্ষে দুর্ভেদ্য দুর্গ প্রাচীরের মতো অটল-অবিচল থাকতে উদ্বুদ্ধ করে। আবহমানকাল থেকে পলাশী পালনের বিভিন্ন ধারা চলে আসছে। আজকের প্রেক্ষাপটই আমাদের এ সময়ের ‘সিরাজ’ হতে প্রেরণা জুগিয়েছে।
প্রতিপক্ষের কাছে সিরাজ অভিযুক্ত, পলাশী তাৎপর্যহীন, আর আমাদের কাছে ইতিহাসের সন্তান সিরাজ স্বাধীনতার প্রতীক। পলাশী তাৎপর্যের। অভিযোগকারী ইংরেজ শাসক, তাদের দোসর বেনিয়াচক্র, সহায়তা দানকারী মীরজাফর, জগৎশেঠ, ঘসেটি বেগমেরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়েও প্রচারণা চালায়, সিরাজ দুর্বল- অদক্ষ, অযোগ্য, অর্বাচীন, নারীলোভী, ক্ষমতান্ধÑ এই কূটবুদ্ধি মাথায় নিয়ে ইউরোপীয় ও হিন্দু ঐতিহাসিকেরা মিথ্যাচার আর বিকৃতি দিয়ে ইতিহাসের নামে আবর্জনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালিয়েছে। সিরাজকে অবাঙালি বহিরাগত বলে আমাদের সামনে কালো পর্দা ঝুলিয়েছে। আমাদের অর্জনকে আড়াল করার জন্য তাঁবেদারদের দিয়ে প্রচারণার ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। সেসব ছিন্ন করে প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্যই আমাদের প্রাণান্ত প্রয়াস থাকাটাই সঙ্গত।
সাহিত্যে-কবিতায়-নাটকে-সিনেমায় আর নিত্যদিনের রাজনৈতিক মঞ্চে সিরাজ অপরিহার্য ও অনিবার্য প্রসঙ্গ। ইতিহাসচর্চায় আড়ষ্টতা থাকলেও সব ধরনের কালো নেকাব সরিয়ে মিথ্যা ও অভিযোগের সীমা ডিঙ্গিয়ে সিরাজ উঠে এসেছেন ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে।
সিরাজ আমাদের জাতীয় বীর। দেশজুড়ে তার ওপর হাজারো স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। সড়কপথ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস সিরাজ স্মরণে উৎসর্গিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মনের মণিকোঠায়, হৃদজগৎজুড়ে, জাতিসত্তার পূর্ণ অবয়বে সিরাজের স্থান, পলাশীর যে অবস্থান সেই তুলনায় আমাদের স্মরণ ও বরণের মাত্রায় আমরা কৃপণ।
আমরা জানি, পলাশী ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপটে আমলাচক্র, বেনিয়াগোষ্ঠী, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভদের অর্থপুষ্টরা, ইংরেজদের পা-চাটা কুকুররা, বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রক ও বুদ্ধিজীবীরা যে ভূমিকা পালন করেছে আজকের দিনেও সেই শ্রেণী চরিত্রগুলো একই স্বরূপ প্রদর্শন করবে। কারণ, সব যুগের সব দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের শ্রেণী-চরিত্র যেমন অভিন্ন। তেমনি, প্রতিপক্ষে বিশ্বাসঘাতক-তাঁবেদার বিদেশী দালালদের স্বরূপ এবং শ্রেণী-চরিত্রও অভিন্ন।
masud2151@gmail.com
http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230425#sthash.JXmpqQUr.dpuf