৫ মে ২০২৪, রবিবার, ৬:২৫

হাওরের কৃষকের গোলাভরা ধান দুশ্চিন্তায় অন্য অঞ্চলের কৃষকরা

কোনো রকম ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই এবার বোরো ধান কাটতে পেরেছেন হাওরাঞ্চলের কৃষক। এপ্রিলজুড়ে তীব্র তাপদাহে মানুষ ও প্রাণিকূল অস্থির সময় পার করলেও খুবই সুন্দরভাবে হাওরের ৭ জেলার কৃষকরা বোরো ধান ঘরে তুলতে পেরেছেন। সর্বশেষ তথ্যমতে প্রায় শতভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে হাওরের ৭ জেলা সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও বি-বাড়িয়ার। তবে, হাওরভুক্ত ৭ জেলা ছাড়া দেশের বাকি সব জেলার কৃষকের মধ্যে এখনো শঙ্কা কাজ করছে ঠিকভাবে ঘরে ধান তুলতে পারবেন কি না। বিশেষ করে চলতি মাসের তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে বৈশাখী বা শিলাবৃষ্টির আশঙ্কা থাকায় সারা দেশের কৃষকরা শঙ্কায় দিন পার করছেন।
এবার হাওরভুক্ত ৭ জেলায় মোট ৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৯৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছিল বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধান চাষ হয় সুনামগঞ্জে, ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬১ হেক্টর ও কিশোরগঞ্জে, ১ লাখ ৩ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে। ২ মে পর্যন্ত ৭ জেলায় প্রায় ৯০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। গত দুদিনে আরো প্রায় ৫ শতাংশ জমি তথা মোট প্রায় ৯৫ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়। এই ৭ জেলা থেকে (হাওর) মোট চাউল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লাখ ৫২ হাজার ৫৫৬ মেট্রিক টন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) জানায়, চলতি মৌসুমে দেশে মোট প্রায় ৫০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। আবাদ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা বেশি। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ২২ লাখ ৬৬ হাজার টন। গত ২ মে’র তথ্যানুসারে সারা দেশে গড়ে প্রায় ২৬.৪৬ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। গত ২ দিনে এ হার ৩০ শতাংশের উপরে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

ডিএই সূত্র আরো জানায়, হাওরভুক্ত ৭ জেলায় হাওর ও নন হাওর মিলিয়ে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ লাখ ৫৭ হাজার ২৫ হেক্টর। এর মধ্যে হাওরে ৪ লাখ ৫১ হাজার ৩৭৬ হেক্টর ও ননহাওর এলাকায় ৫ লাখ ৫ হাজার ৬৪৯ হেক্টর। এবার হাওরে সবমিলিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে বেশি আবাদ হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, হাওরাঞ্চলে প্রধান ফসল বোরো ধান। ওই এলাকার কৃষক দুশ্চিন্তায় থাকেন কখন বৈশাখী ঝড় বা পাহাড়ি ঢলে ধান তলিয়ে যায়। অতীতে হঠাৎই পাহাড়ি ঢলে হাওরের কৃষকের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। ধান পাকা শুরু হলেই পাহাড়ি ঢলে তা তলিয়ে যেত। গত কয়েক বছর হলো অনেকটা নির্ঝঞ্জাটভাবে ফসল ঘরে তুলতে পেরেছেন কৃষক। গতবারও এপ্রিল মাসে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও সিলেটের হাওরাঞ্চলের চার জেলায় প্রায় ৭ হাজার হেক্টর বোরো ধান তলিয়ে যায়। নদনদী উপচে হাওরের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ কৃষিভূমি। এতে শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয় কৃষকের। এবারো পাহাড়ি ঢলের শঙ্কা মাথায় নিয়ে বোরো ধান কাটা শুরু করেন কৃষক। এখন পর্যন্ত ঠিকঠাকভাবেই ধান কাটা চলছে। অবশিষ্ট ধান ভালোভাবেই কৃষক গোলায় তুলতে পারবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি আবহাওয়া তথ্য পদ্ধতি উন্নতকরণ প্রকল্পের কম্পোনেন্ট সি-বিডব্লিউসিএনআরপি দেশের হাওরাঞ্চলের ৭ জেলায় গত শুক্রবার থেকে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের সতর্কতা জারি করে। বোরো ধান ৮০ শতাংশ পাকলেই তা দ্রুত কেটে ফেলার পরামর্শ দেয়া হয়।
প্রকল্পটির পরিচালক ড. মো: শাহ কামাল বলেন, আমরা আবহাওয়া অধিদফতরের বরাত দিয়ে কৃষককে পরামর্শ ও সতর্কতা দিয়ে আসছি।

আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, আজ রোববার ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা/ ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি/ বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। দেশের পশিচমাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে বিরাজমান তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা (১-২) ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেতে পারে। আগামীকাল সোমবারও একই অবস্থার পূর্বাভাস রয়েছে আবহাওয়া অধিদফতরের। তবে সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা (১-২) ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেতে পারে এবং রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বর্ধিত ৫ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, সারা দেশে বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা আরো হ্রাস পেতে পারে।

হাওরের কৃষকরা অনেকটা বিনা ক্ষয়ক্ষতিতে ঘরে ধান তুলতে পারলেও শঙ্কা কাটছে না দেশের অন্যান্য অঞ্চলের কৃষকের। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ ধানকাটা সম্পন্ন হয়েছে সারা দেশে। বাকি ধানকাটা নিয়ে ঝড় ও শিলাবৃষ্টির শঙ্কায় রয়েছেন কৃষকরা। চলমান প্রখর রোদ বা তাপপ্রবাহে ফলজাতীয় ফসলের ক্ষতির মুখে পড়লেও বোরো ধানে তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না বলেই বলছেন কৃষিবিদরা। যেসব জমিতে ধান থোড় অবস্থায় বা ফুল ধরেছে, সেসব জমিতে পর্যাপ্ত পানি রাখার পরামর্শ দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তীব্র তাপপ্রবাহে হাওরের ধান দ্রুত পেকেছে। কৃষকরাও হারভেস্টার দিয়ে ধানকাটা সম্পন্ন করতে পারছেন বলে ডিএই’র কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তাপপ্রবাহে বোরো ধান দ্রুত পাকছে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও। বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা তাপপ্রবাহে চরম কষ্টের মধ্যে থাকলেও তা যেন চলমান থাকে, এই কামনাই করছেন। তাদের মতে প্রখর রোদে শারীরিক কষ্ট হলেও ধানের জন্য ভালো। দ্রুত ধান পাকবে, তারা দ্রুত ঘরে তুলতে পারবেন। তবে, সবসময় তারা দুশ্চিন্তায় থাকেন কখন জানি ঝড় বা শিলাবৃষ্টি শুরু হয়।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/832633