৫ মে ২০২৪, রবিবার, ৬:২৪

শিল্পের চাকা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে প্রতি মাসেই জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা শুরু হয়েছে। অপর দিকে, ভর্তুকি তুলে দিতে প্রতি তিন মাস অন্তর বছরে চার বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। আর এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে একাধারে তিন বছর। এমনই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। তারা জানিয়েছেন, এসব সিদ্ধান্ত দেশের জনগণের স্বার্থ ও শিল্পায়নবিরোধী সিদ্ধান্ত। এমনিতেই ব্যবসায়ীরা নানা কারণে নাজেহাল হচ্ছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। অথচ, রফতানি পণ্যের দাম বিদেশে তেমন বাড়েনি। এতে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা তাদের দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর ওপর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ না পেয়ে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। এর ওপর তিন মাস অন্তর বিদ্যুতের দাম বাড়ালে কোনো শিল্পকারখানাই আর ভালোভাবে টিকতে পারবে না। বেশির ভাগই বন্ধ হয়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। অপর দিকে, শুধু শিল্পের চাকাই বন্ধ হবে না, বিদ্যুতের দাম বাড়ার সাথে সাথে সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বেড়ে যাবে পণ্যের দাম। এমনিতেই সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা কষ্টে আছেন, তা সত্ত্বেও দফায় দফায় দাম বাড়লে নাগালের বাইরে চলে যাবে পণ্যের দাম। এতে দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, মূল্য সমন্বয়ে কি শুধু দাম বাড়বে, কমবে না? তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কখনো বাড়ে, আবার কখনো বা কমে। কিন্তু আমারা দেখতে পাই, আমাদের এখানে মূল্য সমন্বয়ের নামে শুধু জ্বালানি তেলের দাম বাড়তেই থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কমে তখন আর কমে না। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে প্রতি বছরই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। অথচ এর দায় জনগণ ও দেশের শিল্প কারখানাকে বহন করতে হচ্ছে। আবার সিস্টেম লসের নামেও প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বিদ্যুৎ ও তেল চুরি হচ্ছে। তিনি বলেন, এক গ্রুপ বিদ্যুৎ না দিয়ে বসে বসে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার হাজার কোটি টাকা নেবে, আর আরেক গ্রুপ জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে তাদের অর্থের জোগান দেবে এটা হতে পারে না। তিনি মনে করেন, সিস্টেম লসের নামে বিদ্যুৎ চুরি বন্ধ করা গেলে ও ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া বন্ধ করা হলে বিদ্যুতের ভর্তুকি কমে আসবে। এতে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম আর বাড়াতে হবে না। তিনি আরও বলেন, চার বিলিয়ন ডলার ঋণের বিপরীতে আমরা দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারি না। তিনি আইএমএফের যেসব শর্তগুলো দেশের জনগণ ও শিল্পায়নের বিপক্ষে ওইসব শর্তগুলো না মানতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

সর্বশেষ গত মার্চে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা এ বছরের জুন, অক্টোবর ও ডিসেম্বরে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। আগামী দুই বছরে মার্চ, জুন, অক্টোবর ও ডিসেম্বরে আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ভোক্তাদের ওপর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির আকস্মিক প্রভাব কমাতে প্রতিবার অল্প অল্প করে দাম সমন্বয় করা হবে বলে কর্মকর্তারা আইএমএফ দলকে জানিয়েছেন। বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় পাইকারি দাম ৭ টাকা ৪ পয়সা। বিদ্যুৎ ভর্তুকি ছাড়া এ দাম ১২ টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যার ফলে ভোক্তা-পর্যায়ে গড় দাম হবে প্রতি ইউনিট প্রায় ১৫ টাকা বর্তমানে যা ৮ টাকা ৯৫ পয়সা।

ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়লে আগামী বারো মাসের মধ্যে অর্ধেকের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারা বলেছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ব্যাংকের সুদের হার বেড়েছে, এবং সম্প্রতি, টেক্সটাইল শ্রমিকদের মজুরি ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে টেক্সটাইল খাতকে টিকিয়ে রাখা ক্রমে কঠিন বলে মনে হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এটি সমগ্র অর্থনীতিকে পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেয়া ঋণের শর্তপূরণের অংশ হিসেবে বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ এ খাতে ভর্তুকি বিলুপ্তে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তারা মনে করছেন, এটি করা হলে সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে শিল্প-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

জানা গেছে, বিদায়ী গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। সরকারি, বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে এ পরিমাণ বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এ সময় ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় বেড়েছে ৫৬ শতাংশ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আরো অন্তত প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রও রয়েছে। মোট সক্ষমতায় এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র যুক্ত হলে চলতি অর্থবছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের।

গত অর্থবছরে বিপিডিবি বেসরকারি (আইপিপি) ও ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে ৩৪ হাজার ২৫৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে সংস্থাটির অর্থ ব্যয় হয়েছে ৬২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে এ বিদ্যুৎ কেনার পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ১৭৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। আর অর্থ ব্যয় হয়েছিল ৫২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ এক অর্থবছরের ব্যবধানে আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ কম কেনা হলেও ব্যয় বেড়েছে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইপিপি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় বাড়ায় বিপিডিবির গড় উৎপাদন ব্যয়ও ৮ টাকা ৮৪ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ টাকা ৩৩ পয়সায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি, জ্বালানি আমদানি ব্যয়, প্রাক্কলন অনুযায়ী বিদ্যুতের চাহিদা না বাড়ায় সক্ষমতা অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জসহ সবগুলোই এ খাতের ভুল পরিকল্পনার মাশুল। সঠিক প্রাক্কলন ও সময় অনুযায়ী সব কিছু না হওয়ায় এ খাতে আর্থিক ঝুঁকি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিদ্যুৎ খাতে প্রতিনিয়ত ব্যয় বাড়তে থাকায় প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের ভোক্তা পর্যায়ে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হলেও সামগ্রিকভাবে অর্থ সঙ্কট তৈরি হচ্ছে বিপিডিবির।

বিপিডিবির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ভর্তুকি দিয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জ্বালানি আমদানি ও ডলারের মূল্য বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে বিপিডিবির ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ছিল ১ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৬৫৯ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক এ ক্ষতি থেকে বিপিডিবিকে বের হতে হলে বিদ্যমান ক্রয়চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প নেই। পাশাপাশি পুরনো ও অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে। এটি করা গেলে বিপিডিবির বড় আর্থিক সাশ্রয় হবে বলে মনে করেন বিদ্যুৎ খাতের সাবেক নীতিনির্ধারকরা।

প্রসঙ্গত, আইএমএফ-এর কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণচুক্তি করার সময় সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুৎখাতের ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করার অঙ্গীকার করেছে। এ ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের শর্ত বাস্তবায়ন পরিস্থিতি যাচাই করতে ঋণদাতা সংস্থাটির একটি প্রতিনিধিদল বর্তমানে বাংলাদেশ সফরে রয়েছে। বৃহস্পতিবার (২ মে) আইএমএফ-এর প্রতিনিধিদের সাথে পেট্রোবাংলার অফিসে অনুষ্ঠিত সভায় তিন মাস পর পর বিদ্যুতের দাম পর্যায়ক্রমে বাড়ানো এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের পর থেকেই রফতানিতে ভর্তুকি বাতিল হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হলে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে যাবে, যা সম্ভাব্য নতুন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রফতানি প্রতিযোগিতা-সক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া ভর্তুকি পুরোটা অপসারণের ফলে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যেতে পারে। এতে ভোক্তার চাহিদাও কমে যাবে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/832637