২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ৮:১২

বিদ্যুতে ভোগান্তি কমছে না

দেশজুড়ে তাপপ্রবাহে জনজীবন অতিষ্ঠ। খুব প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না অনেকে। স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ঘরেও টিকতে পারছে না দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। বিদ্যুতের ঘাটতিতে অনেক এলাকায় সেচকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

তীব্র গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। গ্রাম এলাকায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এরই মধ্যে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা বেড়েছে। পাশাপাশি অর্থ সংকটে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো কম চালানো হচ্ছে। এ অবস্থায় ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতেও লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। গত রোববার রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় একাধিকবার বিদ্যুৎ যাওয়ার তথ্য মিলেছে। আনুষ্ঠানিক লোডশেডিং শুরু হলে শহরের পরিস্থিতিরও অবনতি হতে পারে।

বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, ৪০০ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। দেশে কমপক্ষে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। শুধু পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডেই (আরইবি) প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে।

দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে গতকাল সোমবার রাত ৯টায়। এ সময় ১৬ হাজার ২৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উৎপাদন বাড়াতে। এর আগে রোববার রাতে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ১৫ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট।

গ্যাস সরবরাহ বাড়লেও লোডশেডিং কমছে না
বিদ্যুৎ বিভাগ এপ্রিল-মে মাসে বিদ্যুতের চাহিদা ধরেছে ১৭ হাজার ৩৮৫ মেগাওয়াট। গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোয় গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ১৪ হাজার ৫০০ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। এর পরও আড়াই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াটের ঘাটতি থাকছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস বেশি সরবরাহ করছে পেট্রোবাংলা। এখন গড়ে দিনে ১৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। গত মাসে সরবরাহ ছিল ১১০ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট। গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোয় বিদ্যুতের উৎপাদন গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বেড়েছে। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এবার গরমে গ্যাস থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট, কয়লা থেকে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েল থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট ও ডিজেলের মাধ্যমে ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। রোববার রাতে ১৫ হাজার ৬৬ মেগাওয়াট উৎপাদনের সময় গ্যাস দিয়ে ৭ হাজার ৭১৬, তেল ব্যবহারে ২ হাজার ৯৫৯ এবং কয়লা দিয়ে ৪ হাজার ৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। গ্যাস দিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে; কিন্তু কয়লা ও তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উৎপাদন করেছে। এর দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, তেল ও কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেশি। রোববার গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি খরচ ছিল ৫০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। গ্যাসের চেয়ে অর্ধেক উৎপাদন করেও কয়লা বিদ্যুতে জ্বালানি খরচ ৬১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। তেল দিয়ে গ্যাসের চেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ কম উৎপাদন করেও খরচ হয়েছে ৮৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। দ্বিতীয়ত, বকেয়া পরিশোধ না করায় তেল ও কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন কম করছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিডিবির কাছে পাবে ১৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পাবে ৬ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ভারতের আদানি গ্রুপ পাবে ৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। এ ছাড়া জ্বালানি সংকটে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং কেন্দ্র মেরামতের জন্য ১ হাজার ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে।

গ্রামে বিদ্যুৎ মাঝেমধ্যে আসে
ঢাকার বাইরে অঞ্চলভেদে চাহিদার তুলনায় ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি থাকছে। বগুড়ার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর এক কর্মকর্তা জানান, চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না পাওয়ায় দিন-রাত মিলে ৭-৮ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক এলাকায় সেচকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। নওগাঁ সদর উপজেলার সরাইল এলাকার কৃষক দেওয়ান মোহাম্মদ বলেন, ভোরে সেচ দিতে গেলেও বিদ্যুৎ থাকছে না। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দিদারুল আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রোববার লেখেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যে চার ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। একে তো গরম, তার ওপর বিদ্যুৎ নেই। কী ভয়াবহ অবস্থা বলে বোঝানো যাবে না। বাড়িতে ছোট বাচ্চা আর বৃদ্ধ থাকলে অবস্থা আরও শোচনীয়।’ গ্রামের মানুষ কি বিদ্যুৎ বিল দেয় না? প্রশ্ন রাখেন দিদারুল। ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে ঘরে টেকা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রংপুরের হনুমানতলা এলাকার গৃহিণী পারভিন বেগম।

শহরে লোডশেডিং বাড়বে
বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা নিয়ে সোমবার সচিবালয়ে বৈঠক হয়েছে। সূত্র জানায়, লোড ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে। এখন থেকে শহরেও যৌক্তিক লোডশেডিং দেওয়া হবে। পাশাপাশি বড় বিপণি বিতান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিষয়ে সাশ্রয়ী নীতি নেওয়া হবে। রাত ৮টার পর মার্কেট বন্ধের নিয়ম কঠোরভাবে মানা হবে।

ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান সমকালকে বলেন, তাঁর এলাকায় এখন পর্যন্ত লোডশেডিং হয়নি। কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ পেয়েছেন। আগামী দিনগুলোর কথা বলা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন সমকালকে বলেন, গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। খরচ বেশি হলেও তেলচালিত কেন্দ্রগুলো চালিয়ে চাহিদা মেটানো হবে। তিনি বলেন, গরম খুব বেশি পড়ছে। এসি-ফ্যানের ব্যবহার বেড়েছে। বিদ্যুতের লোড হুট করে বেড়ে গেছে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, প্রচণ্ড গরমে অনেক সময় সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে হয়। এতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।

https://samakal.com/bangladesh/article/233717