২৫ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ১২:২৯

গ্যাসের রমরমা বাণিজ্য

গ্যাস সংযোগ নিয়ে চলছে লুকোচুরি খেলা। তিতাস নামের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটিতে চলছে রমরমা অবৈধ বাণিজ্য। এ বাণিজ্যে জড়িত প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই। টাকা দিয়েও গ্যাস পাচ্ছে না সরকারি প্রতিষ্ঠান। অথচ অবৈধ পথে গ্যাসের লাইন দেয়া, বাসাবাড়িতে লুকোচুরি করে অবৈধ সংযোগ দিয়ে রমরমা ব্যবসা চলছে। এতে করে প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করেও সাধারণ ভোক্তাদের চুলা জ্বলছে না। রমজানে চুলা জ্বলে না রাজধানীর অনেক এলাকায়।

অবৈধভাবে গ্যাসের রমরমা ব্যবসার বৈধ গ্রাহকরা ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছেন না স্বীকার করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগকারীদের বিরুদ্ধে সবকটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিকে কঠোর অভিযান চালাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের কারণে বৈধ গ্রাহকরা ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছেন না। তাই যে কোনো মূল্যে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের চিহ্নিত করে তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করাসহ আইনের আওতায় আনা হবে।

রাজধানীর মতিঝিলের সরকারি আবাসিক কলোনী (এজিবি) কলোনীতে বৈধভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগের জন্য ৪০ লাখ ৬৩ হাজার ২৬৪ টাকা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের নামে ব্যাংকের মাধ্যমে গণপূর্তের মতিঝিল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গত ২০১৯ সালে ২৬ জুলাই টাকা পরিশোধ করেন। গ্যাস সংযোগের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কলোনীর সরকারি কর্মকর্তারা এবং গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রায় ৫ বছর ধরে ঘুরেও বৈধভাবে গ্যাস সংযোগ পাচ্ছে না। আবার অনেকেই টাকা দিয়ে গ্যাস সংযোগ ব্যবহার করলেও সব সময় গ্যাস পাচ্ছে না। অন্যদিকে যারা অবৈধ ভাবে গ্যাস সংযোগ নিয়ে ব্যবহার করছেন তারা ভালোই সুবিধা ভোগ করছেন। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা অবৈধ গ্যাস সংযোগগুলোতে গ্যাসের প্রবাহ যাতে স্বাভাবিক থাকে সে ব্যাপারে তৎপর। এভাবেই রাজধানীর উত্তরা, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ সারাদেশে অবৈধ গ্যাস সংযোগের ছড়াছড়ি চলছে। অনেক বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানও অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নিয়েছেন। আবার গোপনে গোপনে নিচ্ছেন। এসব অবৈধ সংযোগ দেয়ার সঙ্গে তিতাসের একশ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া নিয়ে এক প্রকার লুকোচুরি করছে তিতাস। বাসাবাড়িতে নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না এ মর্মে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়নি সরকার। কোনো প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়নি। ফলে হাজার হাজার গ্রাহক সংযোগের জন্য গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে টাকা জমা দিয়ে আবেদন করছেন। তাদের বলা হচ্ছে, গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে, এ জন্য সংযোগ এখন দেয়া হবে না। কিন্তু এর মধ্যেই প্রভাবশালীরা নানা উপায়ে ‘ঘুষ দিয়ে’ সংযোগ নিচ্ছেন- এ রকম প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। সংযোগ নিয়ে সরকারের এ অস্পষ্ট অবস্থানের কারণে এ খাতে দুর্নীতি বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। তাদের মতামত হলো, সরকারকে এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান ঘোষণা করা উচিত, তাহলে সংযোগ নিয়ে লুকোচুরি বন্ধ হবে। নতুবা কেউ সংযোগ পাবে, কেউ পাবে না। এ অবস্থা চলতে পারে না। তাছাড়া এ অস্পষ্ট অবস্থানের কারণে সারাদেশে অবৈধ গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন বেড়েছে। গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসের এলাকায় প্রায় ৩০০ কিলোমিটার অবৈধ লাইন রয়েছে বলে তিতাসের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে।

আবার রাজশাহীতে ১১ হাজার গ্রাহকের আবেদনপত্র পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (পিজিসিএল) দফতরে পড়ে আছে। অনেকেই গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ পাওয়ার আশায় ওয়্যারিংসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করেছেন। ব্যয় করেছেন মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু গ্যাস সংযোগ কবে নাগাদ দেয়া হবে সে ব্যাপারে মুখে কুলুপ পিজিসিএলের। এতে সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। দেশজুড়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগের ছড়াছড়ি। বেশি অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিডের (তিতাস) আওতধীন এলাকায়। গত নভেম্বর থেকে চলতি মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসে তিতাস কর্তৃপক্ষ প্রায় ১০০ কিলোমিটার অবৈধ গ্যাস বিতরণ লাইন অপসারণ করেছে। তবু কমছে না অবৈধ গ্যাস সংযোগের পরিমাণ।

জানা গেছে, গত নভেম্বর থেকে চলতি ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখ পর্যন্ত অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী তিতাসের টিম ৯৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে। যার মধ্যে প্রায় ৩২১টি স্পট বা এলাকা রয়েছে। এসব এলাকায় প্রায় শত কিলোমিটার অবৈধ লাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যার মধ্যে ৬২ হাজার ৪২৩টি বার্নার বা চুলা, ৫৭টি শিল্প সংযোগ ও ৫৭টি বাণিজ্য সংযোগ রয়েছে। এ ছাড়া ৪৪টি মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করে অবৈধ গ্যাস সংযোগকারীদের ৪৭ লাখ ৭৩ হাজার ৪০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে ১৫টি ক্যাপটিভ গ্যাস সংযোগ। কর্তৃপক্ষ এখন অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম নিয়েই বেশি ব্যস্ত। ফলে তিতাসের নিয়মিত যেসব কার্যক্রম রয়েছে সেগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন শেণির গ্রাহকরা এ নিয়ে এখন নিয়মিতই অভিযোগ জানাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারি মোট ৬টি কোম্পানি বাসাবাড়িসহ শিল্প-বাণিজ্য খাতে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে। এগুলো হলো- তিতাস, কর্ণফুলী, পশ্চিমাঞ্চল, জালালাবাদ, বাখরাবাদ ও সুন্দরবন। তিতাসের বিতরণ এলাকা হলো- রাজধানী ঢাকাসহ গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও নেত্রকোনা। কর্ণফুলীর বিতরণ এলাকা হচ্ছে, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলো। বাখরাবাদের এলাকা হলো- বৃহত্তর নোয়াখালী ও কুমিল্লা। জালালাবাদের বিতরণ এলাকা হচ্ছে, সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা। পশ্চিমাঞ্চলের দায়িত্বে রয়েছে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী, ঈশ্বরদী, পাবনা, ভেড়ামারাসহ আশপাশ এলাকা। সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি গঠিত হলেও এখনও বিতরণের কাজ শুরু করেনি। এ কোম্পানি খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরাসহ আশপাশ এলাকায় গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে।

তিতাস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তিতাস গ্যাসের আবাসিক সংযোগ সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ ৫৮ হাজার। এছাড়া, বাণিজ্যিক সংযোগ প্রায় ১২ হাজারের মতো। যার মধ্যে প্রায় ১৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। সেখানেও সরবরাহ হচ্ছে, ফলে ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। যে কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন গ্যাস সংকট দেখা যাচ্ছে। আপাতত গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কোনো উপায় তাদের হাতে নেই। আগামী ২০২৬ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খনন ও সংস্কারের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তাতে সফল হলে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট নতুন গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা কূপে গ্যাসের সন্ধানও মিলেছে। পাশাপাশি আরও এলএনজি আমদানির জন্য সরকার যে চুক্তি করেছে তাতেও ২০২৬ সালের আগে নতুন গ্যাস আমদানির কোনো সুযোগ নেই। ২০২৬ সালে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে। তবে আশঙ্কার বয়েছে একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য জানান। তারা বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী কূপ খনন ও সংস্কার করে কাক্সিক্ষত গ্যাস পাওয়া যাবে কি না, সেটা এখনই বলা মুশকিল। তাছাড়া নতুন করে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করতে যে বিপুল পরিমাণ ডলার দরকার সেটি জোগাড় করা না গেলে আমদানি ব্যাহত হবে। এ সময়ে দেশের পুরনো কূপ থেকে গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি চাহিদাও বেড়ে যেতে পারে। ফলে চলমান সংকট কতটা দূর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ৫৬৭টি পোশাক ও ডায়িং কারখানা পৌনে দুই মাস ধরে গ্যাস সংকটে ভুগছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
তিতাসের নারায়ণগঞ্জ জোনের এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের কড়া নির্দেশনা রয়েছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রম জোরালোভাবে চালাতে। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযান নিয়ে ব্যস্ত থাকছি। এতে অন্যান্য স্বাভাবিক কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

তিতাসের পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তিতাস সব ধরনের চেষ্টা করছে। অবৈধ গ্যাস সংযোগের এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে যে, এটি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে অব্যাহতভাবে কাজ করে যেতে হবে। জ্বালানি বিভাগের সিদ্ধান্ত এবং আমাদের অবস্থান কঠোর। অবৈধ গ্যাস ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বেশি নজর দেওয়ার কারণে অন্যান্য কাজে একটু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। বকেয়া আদায়েও কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে।

বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগে লুকোচুরি : নতুন করে রাইজার বসাতে হবে এমন কোনো ভবনে তারা সংযোগ দিচ্ছেন না। কারণ নতুন সংযোগ দেওয়ার জন্য যে মালপত্র প্রয়োজন সেটা কেনার অনুমোদন নেই। তবে সম্প্রসারিত সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ যে ভবনে রাইজার আছে সেখানে চুলার সংখ্যা বাড়ানোর অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এ সুযোগে বহু স্থানে প্রভাবশালীরা অবৈধ লাইন তৈরি করে সংযোগ নিচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সংযোগ বন্ধের কোনো সার্কুলার না থাকায় গ্রাহকরা আবেদন করে যাচ্ছেন। তাদের বিরত রাখা যাচ্ছে না।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় তিতাস এলাকায় বাসাবাড়িতে নতুন ও সম্প্রসারিত মিলিয়ে প্রায় এক লাখ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এখনও আবেদন জমা আছে সাড়ে ১০ হাজার। তবে প্রভাবশালীরা নতুন সংযোগ পাচ্ছেন। তবে তাদের সংখ্যা খুবই সীমিত।

https://dailyinqilab.com/national/article/647375