২৫ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ১২:০০

নৈতিকতার ভিত্তিতে সমাজ গঠনের বিকল্প নেই

-আলী আহমাদ মাবরুর

আমরা ভালো নেই। নিজেদের অবস্থান বা পরিস্থিতি নিয়ে ভালো নেই। পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে আমরা আরো বেশি বিষন্ন। তারা কেমন থাকবে, কিংবা কোন ধরনের পৃথিবীতে আমরা তাদের রেখে যাবো-তা নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুঁ মারলে সমাজের যে চিত্র আমাদের সামনে আসে তা আমাদেরকে আরো বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলছে। এ থেকে কীভাবে আমাদের উত্তরণ ঘটবে, আদৌ ঘটবে কিনা-তা আমরা জানি না।

সমাজের যারা নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে রয়েছেন, যারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর-তাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাদের ভূমিকা একেবারেই রাজনীতি আর গতানুগতিক কিছু বিষয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। নতুন নতুন দল তৈরি হচ্ছে, নানা ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্ম নিচ্ছে। কী সুন্দর সুন্দর সব কথা বলে তারা আবির্ভূত হচ্ছে। আমরা আশায় বুক বাঁধি। কিন্তু কিছুদিন পর সেই আশায় গুড়ে বালি। যেমনভাবে চলছিল সব সেভাবেই সব চলমান থাকে।

এটি এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, আমাদের পুঁথিগত শিক্ষিতের হার বাড়ছে, গড়পড়তার আয় বাড়ছে কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা ক্রমশই নীচের দিকে নামছি। এর একটি বড়ো কারণ হলো সমাজ থেকে নৈতিকতা হারিয়ে গেছে। নীতি ও নৈতিকতা কোনো ট্যাবলেট বা পিল নয়-যা ঠাস করে গিলে ফেলা যায়। নীতি ও নৈতিকতা একটি আদর্শিক ও নীতিগত অবস্থান যা প্রধানত ধর্ম থেকে সঞ্চারিত হয়। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধর্মকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা কার্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তকে যেমন ধর্মীয় বিষয়াদির গুরুত্ব কমিয়ে দেয়া হয়েছে, তেমনি অন্যান্য ক্ষেত্রেও ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে দেয়া হয়েছে।

আমাদের পেশাগত কার্যক্রম, আমাদের মূল্যায়ন, জাতীয় পুরস্কার কিংবা কাউকে সম্মানিত ও অসম্মানিত করার যে মানদন্ড, সেখানে অনেক আগেই ধর্মকে বাদ দেয়া হয়েছে। আমরা ধর্মকে বাদ দিয়ে চলতে শিখে গিয়েছি। প্রথমদিকে এর প্রভাব ততটা বোঝা যায়নি। তাই হয়তো প্রতিবাদ বা সচেতনতাও ছিল বেশ দায়সাড়া মানের। কিন্তু দিন যত যােেচ্ছ, অধর্মের প্রভাব তত প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে, পাঠ্যবই শুধু নয়, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেসব খবরাখবর বাইরে বেরিয়ে আসছে কিংবা সমাজে ও পরিবারে সম্পত্তি নিয়ে যেসব হৃদয়বিদারক ঘটনার কথা আমরা জানতে পারছি কিংবা পেশাজীবীদের অনৈতিক মানসিকতা এবং টাকার লোভে মানুষের জীবনকে নষ্ট করে দেয়ার একের পর এক দৃষ্টান্ত যেভাবে আমাদের গোচরে আসছে-তাতে এটি অনেকটাই স্পষ্ট যে, আমাদের সমাজকাঠামো প্রবলবেগে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে।

অধপতনের এ গতির লাগাম কখনো টেনে ধরা যাবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়। নীতি নির্ধারকেরাও এসব বিষয় কতটা গুরুত্ব দিবেন তা আমরা জানি না। তবে আমাদের দিক থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত করা জরুরি আর তাহলো আমাদের নিজেদের সচেতনতা বৃদ্ধি। পরিবারের গঠনে, সন্তানদের প্রতিপালনে আরো বেশি তৎপর হওয়া প্রয়োজন। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর সমাজের অস্থিরতা ও অনৈতিকতার আস্ফালন নিয়ে আলাপচারিতা বৃদ্ধি করা দরকার। যাতে তারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারেন এবং সেই আলোকে নিজেরা প্রস্তুতি নিতে পারেন আবার একইসঙ্গে সন্তানদেরকেও দিক নির্দেশনা প্রদান করতে পারেন।

সর্বত্র নৈতিকতার বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক নৈতিকতার প্রচার ও প্রসার ঘটানো জরুরি। নৈতিকতা হলো একটি বোধ ও চিন্তাশক্তি। যার মধ্য দিয়ে মানুষের কার্যক্রমগুলোর যথার্থতা মুল্যায়ন করা হয়। একটি কাজ ভালো হচ্ছে নাকি মন্দ-সেই বোধ আমাদের থাকা প্রয়োজন। আমার কাজে আমার লাভ হচ্ছে কিন্তু অপরের ক্ষতি হচ্ছে কিনা-সেই দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যালোচনা সবারই থাকা দরকার। অপরের অকল্যাণে যেন আমরা স্বস্তি না পাই, আমার কাজের কারণে যেন কারো চোখে পানি না ঝরে সেই সচেতনতা ও আকাক্সক্ষা আমাদের লালন করতেই হবে।

নৈতিকতা আমাদের এই সমাজের জন্য অপরিহার্য। প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজেদের ধর্মের কাছে ফিরে আসতেই হবে। বিশেষ করে যারা মুসলিম তাদেরকে ইসলামের সাথে আরো বেশি ঘনিষ্ঠ হতে হবে। ইসলাম হলো অসংখ্য নীতিমালার সংকলন। ইসলাম যেভাবে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ ও অকল্যাণের মানদন্ড নির্ধারণ করে দিয়েছে অন্য কোনো দর্শন তা পারেনি। আর পারার কথাও নয়। কেননা, অন্য সব মতবাদ ও দর্শন যেখানে মানুষের তৈরি সেখানে ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করেছেন মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আর তিনি যেহেতু মানুষের সৃষ্টিকর্তা, তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষের জন্য কোনটি ভালো কিংবা কোন বিষয়গুলোতে মানুষের পদস্খলন হয় তাও আল্লাহ তাআলাই বেশি ভালো জানেন। আল্লাহ তাআলা নিজে কুরআন মজিদে ঘোষণা দিয়েছেন, “যারা (মানুষেরা) সৃষ্টিই করতে পারে না তারা কি কখনো সৃষ্টিকর্তার সমকক্ষ হতে পারে?” (সুরা নাহল: ১৭)
এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখা জরুরি। শুধু ভালো কাজ করাই যথেষ্ট নয়। বরং সমাজকে সঠিক পথে রাখতে হলে নিজে খারাপ করা থেকে বিরত থাকতে হবে তেমনি অন্যকেও মন্দ কাজ করা থেকে বিরত রাখতে হবে। এমনকী নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে যে অন্যায় করে তার বিরুদ্ধেও সরব হওয়ার জন্য ইসলাম শিক্ষা দেয়। ইসলামের এই বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গিটি ব্যতিক্রম। ইসলাম যেভাবে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা এবং বিরত থাকার কথা বলে তা অন্য কোনো দর্শন বলে না। আল কুরআনে ভালো কাজ করার আর মন্দ কাজ থেকে নিবৃত্ত করার তাগিদ একইসাথে উচ্চারিত হয়েছে।

নৈতিকতার পাশাপাশি চাই মূল্যবোধের অনুশীলন। মূল্যবোধ হলো একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ বিশ^াস ও নীতিমালা। মূল্যবোধের ওপর ভর করেই মানুষ তার যাপিত জীবনে নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। তাই যদি কারো মূল্যবোধ সংহত ও ইতিবাচক হয় তাহলে তার জীবনও হয় ইতিবাচক। আর যদি কারো জীবনে মূল্যবোধের অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় তাহলে তার জীবনেও এর বাজে প্রভাব পড়ে। তাছাড়া মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়েই একজন ব্যক্তির আদব, ব্যবহার ও শিষ্টাচার তৈরি হয়। ব্যক্তির মন কতটা স্বচ্ছ, কিংবা কতটা কলূষিত বা কতটা একপেশে কিংবা কতটা নিরপেক্ষ তাও নির্ভর করে তার মূল্যবোধের ওপর। মূল্যবোধ যেমন একান্তই একজন ব্যক্তির মূল্যবোধ হতে পারে। আবার রাজনীতি বা সংস্কৃতির মতো ক্ষেত্রেও মূল্যবোধের লালন করা যায়।

শুধু এটুকুই নয়, মূল্যবোধ একজন ব্যক্তিকে অনন্য এক মানব সম্পদে পরিণত করে। একজন মূল্যবোধহীন মানুষের তুলনায় একজন মূল্যবোধে সমৃদ্ধ মানুষ অনেক বেশি নৈতিক, পরিশ্রমী, সময় ধরে কাজ করা, আমানতদার, ওয়াদা পালনকারী, উত্তম শিষ্টাচার সম্পন্ন, লেনদেনে স্বচ্ছ হয়ে থাকে। এ কারণে পরিবারের ভেতর যেমন এ ধরনের লোকদের গুরুত্ব বেশি থাকে তেমনি অফিস আদালতে বা পেশাগত পর্যায়েও এ লোকগুলোর চাহিদা ও গুরুত্ব তুলনামূলক বেশিই হয়ে থাকে।

নৈতিকতার সাথে উত্তম শিষ্টাচারের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ইসলামে শিষ্টাচার ও সদাচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ; প্রাত্যহিক জীবনের সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রেও এটিই আসল ভিত্তি। শিষ্টাচারের বদৌলতেই একজন মানুষ সমাজে বা ইসলামী সম্প্রদায়ে নিজের স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়। যারা ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে অনুসরণ করেন তারা এটিও বিশ্বাস করেন যে, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সামাজিক শিষ্টাচার অনুশীলনের মাধ্যমে একদিকে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় অন্যদিকে এ ধরনের উত্তম ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে এবং সামষ্টিক পর্যায়ে মানুষের জন্য কল্যাণকর। কারণ এর মাধ্যমেই সমাজে ও ব্যক্তিজীবনে সুখ, শান্তি ও উন্নতি নিশ্চিত হয়।

আমরা চারপাশে অহরহই দেখতে পাচ্ছি, বাহ্যত অনেক ধার্মিক মানুষ নানা ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। এর একটি বড়ো কারণ হলো সেই ব্যক্তির মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মানদন্ড স্পষ্ট নয়। সে ধর্মকে মানলেও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সে আত্মস্থ করতে পারেনি। ফলে, একটু বড়ো কোনো অফার পেলে কিংবা একটু বেশি প্রতিকূলতার আভাস পেলেই সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। এতে করে ধর্ম সম্বন্ধেও মানুষের মধ্যে নানা ধরনের নেতিবাচক ধারণার তৈরি হয়। এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের তুলনায় ধার্মিক মানুষদের বরং আরো বেশি মূল্যবোধে সমৃদ্ধ হওয়া জরুরি।

নৈতিকতা ও মূল্যবোধ আমাদের সমাজে কমে এসেছে বলেই এখন মানুষ একটি কাজ করার আগে এর পরিণতির কথা চিন্তা করে না। যদি এ দুটো ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য সমাজে বিদ্যমান থাকতো তাহলে মানুষের বিশ^াসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা আরো পোক্ত হতো। কারণ মানুষ তখন কাজ করার পরিণাম সম্পর্কে সচেতন হতো। এতে করে তার নেতৃত্বের দক্ষতা যেমন বাড়তো, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়াও উন্নত হতো এবং সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির এবং সমাজের কল্যাণ হতো।

আমরা এমনই এক অসহনীয় বাস্তবতার ভেতর রয়েছি যেখানে একজন চিকিৎসক গর্ভবতী রোগীকে না দেখেই তার চিকিৎসা করার উদ্যোগ নিচ্ছেন, এমনকী সার্জারি করার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন-যার পরিণতিতে রোগীকে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে খাতনা করতে গিয়ে একাধিক শিশুর যেভাবে মৃত্যু হলো-তা আমাদের অন্তরকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এ্যান্ড্রোসকপি করতে গিয়েও একজন রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা এসব ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যাও দিতে পারেন। তবে, এটুকুতে আমাদের সকলকে একমত হতেই হবে, আমরা অপরের কল্যাণের বিষয়টিকে খুব কমই অগ্রাধিকার দিতে পারছি।

আমরা শিক্ষিত হচ্ছি, উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছি কিন্তু আমরা স্বার্থপরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। আমরা নিজের স্বার্থ কিংবা উপার্জনে সামান্য কমতি দিয়ে অন্যকে নিয়ে ভাবতে রাজি নই। বেইলী রোডের অগ্নিকা-ের কথাও ভাবা যায়। এতগুলো রেস্তোঁরা, এগুলো যারা তৈরি করেছে, যারা এ ভবন তৈরি করেছে, কেউই অশিক্ষিত নয়। কিন্তু তারা জেনে শুনে অনেকগুলো অন্যায় করেছে। তারা মূল নকশা অনুযায়ী ভবন বানায়নি। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য তারা যেমন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়েছেন তেমনি উচ্চ শিক্ষিত কর্মকর্তারাও সামান্য কয়টি টাকার জন্য জেনেশুনে অন্যায়গুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন। এর পরিণামে জীবন চলে গেলো কতগুলো মানুষের।

সাম্প্রতিক সময়ে যে হৃদয় বিদারক ঘটনাগুলো ঘটছে, সবগুলোই আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে যেন দেখিয়ে দিচ্ছে যে, শুধুমাত্র নীতি নৈতিকতার অভাবের কারণেই আমরা সব কিছু হারিয়ে ফেলছি। জীবন চলে যাচ্ছে, ভবন পুড়ে যাচ্ছে আর সবচেয়ে বড়ো কথা সমাজ দ্রুতবেগে অতল গহ্বরে নেমে যাচ্ছে। আমরা সচেতন হই। পরিবার গঠনে সময় দেই। নীতিবোধ, মূল্যবোধ আর নৈতিকতার অনুশীলনকে নিয়মিত এবং সর্বত্র প্রচলন ঘটানোর চেষ্টা করি। কেবলমাত্র ধর্মীয় মূল্যবোধ আর নৈতিকতাই আমাদের বাঁচাতে পারবে, অন্য কিছু নয়।

https://www.dailysangram.info/post/552199