৩ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ২:৫৯

পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, রাবার বুলেট নিক্ষেপ

 

রাজধানীর মিরপুর, গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে গাজীপুর ও আশুলিয়ার অনেক কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল কাজ শুরু হলেও শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে অনেক কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া আগের দিনই অনেক কারখানা  শুক্রবার পর্যন্ত ছুটির নোটিশ টানিয়ে দেয়। বিক্ষোভ চলাকালে গতকাল রাজধানীর মিরপুরের পূরবী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে পোশাক শ্রমিকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর দাবিতে চতুর্থ দিনের মতো বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। ঘণ্টাখানেক পর অ্যাকশনে যায় পুলিশ। টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে তাদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। করা হয় লাঠিচার্জও। এ সময় কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।

সংঘর্ষের পর সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার দিকে শ্রমিকদের সরিয়ে সড়কে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুলিশ বলেছে, পোশাক শ্রমিককেরা মিরপুরে বিআরটিসির বাস ডিপোতে ঢুকে কয়েকটি বাস ভাঙচুর করে। তাদের মধ্যে সন্দেহভাজন ৪-৫ জনকে আটক করা হয়েছে।

আন্দোলনরত শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মিছিল নিয়ে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ১১ নম্বরের দিকে যাওয়ার পথে কয়েকশ’ পুলিশ ধাওয়া দিয়ে পূরবীর দিকে নিয়ে যায়। এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। 
সকাল ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। এ সময় শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এর আগে সকালে ১০ নম্বর গোল চত্বরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের অবরোধে বিরোধী অবস্থানে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে শ্রমিকরা। এ ছাড়া মিরপুর-১২ নম্বর বিআরটিসি বাস ডিপোতে ঢুকে শ্রমিকরা কয়েকটি বাস ভাঙচুর করেন। চতুর্থ দিনের সকাল ৯টা থেকে মিরপুর ১১ নম্বর ও পূরবীর মূল সড়ক আটকে বিক্ষোভ করে ইপিলিয়ান নিটওয়্যার লিমিটেড, অ্যাপোলো নিটওয়্যার ও স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টসের শ্রমিকরা। পুলিশ অ্যাকশনে যাওয়ার পর প্রধান সড়ক ও অলিগলি থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে দেয় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় ছোট ছোট মিছিল নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এলাকা প্রদক্ষিণ করে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে শ্রমিকরা মিরপুরের বিভিন্ন এলাকার অলি-গলিতে ছড়িয়ে যায়। দুপুর ১২টা থেকে পূরবী সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ ছাড়াও পূরবী সিনেমা হলের সামনে ব্যাপক পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিল। বিজিবি ও র‌্যাবের গাড়িকে টহল দিতে দেখা গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ৯টা থেকে পূরবীর সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেন ইপিলিয়ান, অ্যাপোলো নিটওয়্যার ও স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টেসের শ্রমিকরা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১১টা ৪০ মিনিটের মধ্যে শ্রমিকদের সরিয়ে সড়কে অবস্থান নেয় পুলিশ। 
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মহসিন বলেন, সকালে মিরপুর ১০ নম্বরে আমাদের উপর হামলা চালায় শ্রমিকরা। একপর্যায়ে গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তাদের বুঝিয়ে সরিয়ে দিতে গেলে আবারো পুলিশের উপর হামলা হয়। আমরা তাদের মেইন রোড থেকে সরিয়ে দিয়েছি। যাতে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।

ডিএমপি’র মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাজমুল হাসান বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শ্রমিকদের ভেতরে কিছু অবরোধের পক্ষের নাশকতাকারী ঢুকে গেছে বলে আশঙ্কা করছি। তারা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করছে। ছোট একটা সংঘর্ষ হয়েছে। আমাদের কয়েকজন পুলিশ সদস্য সামান্য আহত হয়েছে। আন্দোলনকারী পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে অবরোধকারীরা থাকতে পারেন বলে তাদের ৪-৫ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

আশুলিয়ায় কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভ 
আশুলিয়ায় মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের পঞ্চম দিনে দুটি কারখানায় ভাঙচুর করেছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। এ সময় কারখানার গ্যারেজে রাখা একটি প্রাইভেট কার ও একটি নোয়া মাইক্রোবাসে ভাঙচুর করে শ্রমিকরা। গতাকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আশুলিয়ার কাঠগড়া উত্তরপাড়া এলাকায় অবস্থিত ফ্যাশন গ্লোব গ্রুপের এআর জিন্স প্রডিউসার লিমিটেড ও নাসা গ্রুপের সাইন অ্যাপারেলস কারখানায় এ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। 

প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক ও স্থানীয়রা জানায়, সকাল ১০টার পর হঠাৎ পার্শ্ববর্তী আগামী অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিকরা একত্রিত হয়ে ফ্যাশন গ্লোব গ্রুপের আর জিন্স প্রডিউসার লিমিটেড কারখানায় হামলা চালায়। এ সময় তারা সেখানকার শ্রমিকদের বের করে নিয়ে যায় এবং কারখাটির গ্যারেজে পার্কিং করে রাখা একটি প্রাইভেটকার ও নোয়া মাইক্রোবাসে ভাঙচুর চালায়। খবর পেয়ে শিল্প পুলিশের সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ধাওয়া দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের চেষ্টা করলে বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ফ্যাশন গ্লোব গ্রুপের কোম্পানি সচিব আরএকে লিটন বলেন, সকাল থেকে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কারখানায় কাজ চলছিল। সকাল ১০টার পর পার্শ্ববর্তী আগামী অ্যাপারেলসের শ্রমিকরা হঠাৎ বের হয়ে এসে আমাদের কারখানায় হামলা চালিয়ে শ্রমিকদের বের করে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় আজকের জন্য কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। 

শিল্প পুলিশ জানায়, বেলা ১২টা পর্যন্ত আশুলিয়ার পরিস্থিতি সার্বিকভাবে ভালো ছিল। সোয়া ১২টার দিকে কাঠগড়া আমতলা এলাকায় কয়েকটি কারখানার ২-৩ হাজার শ্রমিক হঠাৎ নাসা গ্রুপের সাইন অ্যাপারেলস কারখানায় ভাঙচুর চালায়। এ সময় শ্রমিকরা ইটপাটকেল ছুড়ে কারখানার গ্লাস ও সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আশুলিয়ার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জামগড়া, ছয়তলা, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুরসহ বিভিন্ন সড়কের পাশে অবস্থিত কিছু কারখানা ছাড়া অধিকাংশ কারখানাই বন্ধ রয়েছে। গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সরোয়ার হোসেন বলেন, আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশতাধিক কারখানায় শুক্রবার পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে নোটিশ দিয়েছে। আজও ৬টি কারখানার শ্রমিকেরা সকালে কাজে যোগদান করেছিল। ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর তারা কারখানা থেকে বের হয়ে যায়। শিল্প-কলকারখানার নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন পয়েন্টে কারখানার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে জলকামানসহ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। আমরা ৩০ থেকে ৩৫টি পোশাক কারখানার ছুটির নোটিশ পেয়েছি। কিছু কারখানায় সকালে কাজ শুরু হলেও পরে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে শ্রমিকরা জড়ো হয়ে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করেছিলেন, আমরা তাদের সরিয়ে দিয়েছি। এ ছাড়া যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের পাশাপাশি নিয়মিত বিজিবির টহল কার্যক্রম চলমান আছে। 

গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভে সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ
গাজীপুরে বেতন বাড়ানোর দাবিতে গতকালও বিক্ষোভে নামেন শ্রমিকরা। এ সময় মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল ছুড়ে শ্রমিকদের সরিয়ে দেয়। এ অবস্থায় অধিকাংশ কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়।

গতকাল সকালে গাজীপুর মহানগরের ভোগড়া বাইপাস এলাকার টিএম ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে। এর পর পরই চৌধুরীবাড়ী এলাকায় বেলমন্ড গার্মেন্টস, রুয়া ফ্যাশন লিমিটেডসহ অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে কারখানার সামনে অবস্থান নেয়। সাড়ে ৮টার দিকে শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে মিছিল নিয়ে অবরোধ করার চেষ্টা করলে শিল্প পুলিশ ও বাসন থানা পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এ ছাড়া মহানগরের চৌধুরীবাড়ী এলাকার বেলমন্ড গার্মেন্টস, রুয়া ফ্যাশন লিমিটেডসহ আশপাশের কারখানার শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতে বিক্ষোভ করেন। তেলিপাড়া এলাকায় বিক্ষোভ করছেন কয়েকটি কারখানার শ্রমিক। একই দাবিতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ইটাহাটা এলাকায় বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। তারা সড়ক অবরোধ করতে চাইলে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। সকাল ১০টার দিকে গাজীপুর সদর উপজেলার বাঘের বাজার এলাকায় কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নেমে অবরোধ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছুটে যান। 

পোশাক শ্রমিকদের গত কয়েকদিনে বেতন বাড়ানোর দাবিতে চলমান আন্দোলন এবং অবরোধ পরিস্থিতি নিয়ে নিরাপত্তা জোরদার করতে গাজীপুরে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। গতকাল সকাল ১০টা থেকে গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, শ্রীপুরের মাওনা এলাকা এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিজিবি’র টহল দেখা যায়। জেলা প্রশাসক আবুল ফাতেহ মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম জানান, গাজীপুরে ১৬ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আগেই বিজিবি মোতায়েন করা হলেও বৃহস্পতিবার এর পরিধি বাড়ানো হয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=81674