৩ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ২:৫৮

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বহুমুখী ঝুঁকিতে

ঋণ আদায় কমেছে, খেলাপি ঋণ বেড়েছে, মূলধন কমেছে

 

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত বহুমুখী ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোতে সুদের হার বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া, এর বিপরীতে মূলধন হ্রাস, আয় কমে যাওয়া, ঋণ আদায় কম হওয়াসহ নানা ঝুঁকির মুখে পড়েছে আর্থিক খাত। বিদ্যমান অর্থনৈতিক মন্দায় ব্যবসা-বাণিজ্য নিম্নমুখী হওয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার পরিধিও কমে গেছে। এর মধ্যে নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাত বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে।

বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদন. জানুয়ারি-মার্চ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। গত মার্চ পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। জুনে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।

প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কমেছে, বেড়েছে খেলাপি ঋণ। এতে ব্যাংকগুলোর মূলধন কমে গেছে। একই সঙ্গে ঋণ থেকে সুদ আয় ও মূলধন থেকেও আয় কমে গেছে। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মূলধন কমা ও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তিতে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এখনো ব্যাংকগুলো স্বাভাবিক বৈদেশিক বাণিজ্য করতে পারছে না। উলটো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে দেনা শোধ করায় তারল্যের একটি বড় অংশ আটকে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চড়া সুদে অর্থ ধার করে ব্যাংকগুলোকে তারল্য ব্যবস্থাপনা করতে হচ্ছে। এতে তাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

এর মধ্যে নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। ব্যাংকে সম্পদ ও মূলধন থেকে কিছুটা আয় হলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওই দুই খাত থেকেই কোনো আয় হচ্ছে না। উলটো দুই খাতেই লোকসান বাড়ছে। তবে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির পাশাপাশি বড় খেলাপিদের কাছে বড় অঙ্কের ঋণ আটকে যাচ্ছে। এতে করে যেসব ব্যাংকে বড় খেলাপি বেশি ওইসব ব্যাংকেই খেলাপি ঋণের পরিমাণও বেশি। মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে রয়েছে ৬১ দশমিক ৯০ শতাংশ। বাকি ৫১টি ব্যাংকে রয়েছে খেলাপি ঋণের ৩৮ দশমিক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের প্রায় ৬২ শতাংশই শীর্ষ ১০ ব্যাংকের কাছে। এদিকে শীর্ষ ৫ ব্যাংকে রয়েছে মোট খেলাপি ঋণের ৪৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বাকি ৫৬ ব্যাংকে রয়েছে ৫৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। খেলাপি ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রাও বেড়েছে। ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে খেলাপি ঋণও বেড়েছে। জুনে তা আরও বেড়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর সম্পদ বা ঋণ থেকে আয় হয়েছে দশমিক ৬২ শতাংশ। গত মার্চে তা কমে দশমিক ৩৯ শতাংশ হয়েছে। আলোচ্য সময়ে আয় কমেছে প্রায় অর্ধেক। ব্যাংকগুলোর যে আয় হয় তার সিংহভাগই আসে সুদ থেকে। এ খাতে আয় কমে যাওয়ায় ব্যাংকের সার্বিক আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এদিকে মূলধন থেকে আয়ও কমে গেছে। ডিসেম্বরে মূলধন থেকে আয় ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। মার্চে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশে। তবে পরিমাণগতভাবে মূলধন থেকে আয় কম হয়। সুদ থেকেই বেশি আয় হয়। করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় ঋণ আদায় ও সুদ আদায়ে ছাড় দেওয়ার কারণে এ খাত থেকে আয় কমেছে।

ব্যাংকগুলোর মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮টি ব্যাংকের। ১৫ শতাংশের বেশি থেকে ২০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ৩টি ব্যাংকের। ১০ শতাংশের বেশি থেকে ১৫ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ আছে ৫টি ব্যাংকের। ৫ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ ১৪টি ব্যাংকের। ৩ শতাংশের বেশি থেকে ৫ শতাংশের কম ১৮টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। ২ শতাংশের বেশি থেকে ৩ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ৭টি ব্যাংকের। ২ শতাংশের কম খেলাপি ঋণ রয়েছে ২টি ব্যাংকের। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের বেশি থাকলেই ওই ব্যাংককে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বর্তমানে দেশে ৪৮টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩ শতাংশের ওপরে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ৪৮টি ব্যাংকই এখন খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে। বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি থাকলে ওই ব্যাংককে ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করে। ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে ৩০টি ব্যাংকের। এ হিসাবে ৩০টি ব্যাংক ঝুঁকিতে।

ডিসেম্বরে ৪টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছিল, মার্চে ৪টি ব্যাংকের বেড়েছে। ডিসেম্বরে ৩ জন শীর্ষ গ্রাহক খেলাপি হলে ১১টি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়ত। গত মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫টিতে। অর্থাৎ ৩ জন শীর্ষ ঋণ গ্রাহক খেলাপি হলে ১৫টি ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে। ডিসেম্বরে ১টি খাতে সবচেয়ে বেশি বেড়েছিল খেলাপি ঋণ। মার্চে তা বেড়েছে ৩টি খাতে। সুদের হারের ঝুঁকিতে ডিসেম্বরের মতো গত মার্চেও রয়েছে একটি ব্যাংক।

ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারের ঝুঁকিতে ডিসেম্বরে কোনো ব্যাংক না থাকলেও মার্চে একটি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়েছে। মূলধন ঝুঁকিতে ডিসেম্বরে কোনো ব্যাংক না থাকলেও মার্চে একটি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়েছে।

ব্যাংকগুলোতে ঋণ ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। মোট ঝুঁকির ৮৮ দশমিক ১৮ শতাংশ ঋণে। তবে গত ডিসেম্বরের তুলনায় মার্চে ঝুঁকি কিছুটা কমেছে।

ব্যাংকগুলোর মূলধন কমেছে। ডিসেম্বরে মূলধন ছিল ১ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকা। মার্চে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকায়।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডিসেম্বরে মূলধন ছিল ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা। মার্চে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকায়। এর মধ্যে মৌলিক মূলধন একই সময়ে ৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা থেকে কমে ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা হয়েছে। মূলধন পর্যাপ্ততাও কমছে। ডিসেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। মার্চে তা কমে ৭ দশমিক ২৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদ থেকে আয় ডিসেম্বরে ছিল ১ দশমিক ২৭ শতাংশ নেতিবাচক। মার্চে তা বেড়ে ১ দশমিক ৩২ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে। একই সময়ে মূলধন থেকে আয় ১৯ দশমিক ২৬ শতাংশ নেতিবাচক থেকে এখন বেড়ে ২০ দশমিক ৬৮ শতাংশ নেতিবাচক হয়েছে। অর্থাৎ মূলধন ও সম্পদ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গড়ে কোনো আয় হচ্ছে না। উলটো লোকসানের অঙ্ক বেড়ে যাচ্ছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ডিসেম্বরে ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। মার্চে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকায়। ওই সময়ে খেলাপি ঋণের হার ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/735778