২৯ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ৭:৪৮

গণপরিবহণ উধাও ফাঁকা রাজধানী

বুড়িগঙ্গা ও তুরাগে নৌকায় যাত্রী পারাপার বন্ধ : হেঁটে গন্তব্যে অসংখ্য মানুষ

 

প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ-সংঘর্ষ ঘিরে শনিবার রাজধানীতে গণপরিবহণ চলাচল ছিল না বললেই চলে। দুপুরের পর কিছু সময় কয়েকটি এলাকায় হাতেগোনা কিছু সংখ্যক বাস চলতে দেখা গেছে। সংঘাতের খবর ছড়িয়ে পড়লে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। এদিন রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও ছিল নগণ্য। সিএনজি অটোরিকশা, রিকশা ও ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চলাচল ছিল সামান্য। কেরানীগঞ্জ-সদরঘাট এবং টঙ্গীর তুরাগ নদীতে নৌকায় যাত্রী পারাপারও বন্ধ করে দেওয়া হয়।

নগরীতে সাধারণ মানুষের চলাচলও কম ছিল। প্রধান সড়কগুলোতে দোকানপাট বন্ধ ছিল। ফলে সমাবেশ এলাকাগুলো বাদে রাজধানীর বাকি এলাকাগুলো ছিল ফাঁকা। জরুরি প্রয়োজনে যারা রাস্তায় বের হয়েছেন তাদের গণপরিবহণ সংকটে পড়তে হয়েছে। গাড়ি না পেয়ে বাধ্য হয়ে অনেককে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। কেউ কেউ বাড়তি ভাড়া গুনে গেছেন গন্তব্যে। তবে ঢাকা নদী বন্দর (সদরঘাট) থেকে লঞ্চ চলাচল করেছে। শুক্রবারের চেয়ে শনিবার ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার লঞ্চের সংখ্যা কম ছিল।

রাজধানীর সদরঘাট, পল্টন, ফার্মগেট, মিরপুর, বাড্ডা, কুড়িল ও উত্তরার বিভিন্ন স্থান ঘুরে যুগান্তর প্রতিবেদকরা এমনই চিত্র দেখেছেন। তারা জানিয়েছেন, সড়ক ফাঁকা থাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীরা কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম জানান, সেগুনবাগিচা থেকে বারিধারায় মাত্র ১৫ মিনিটে পৌঁছেছেন। তিনি বলেন, জরুরি কাজে অফিসে যেতে হয়েছে। সড়কের কোথাও সিগন্যাল পড়েনি, ছিল না যানজট। রাস্তায় কিছু সংখ্যক রিকশা ও সিএনজি ছাড়া অন্য কোনো গণপরিবহণ চোখে পড়েনি। গাজীপুরের বোর্ড বাজার থেকে রিকশাযোগে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর আসেন ব্যবসায়ী নিয়াজ উদ্দিন। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকেও বাস পাইনি। বাধ্য হয়েছে ১২০ টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশায় আসতে হয়েছে।

মিজানুর রহমান চাকরি করেন তেজগাঁও এলাকার একটি ছাপাখানায়। কর্মস্থলে যেতে সকাল ৯টার দিকে নিজ বাসা থেকে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকা পৌঁছান। তিনি বলেন, কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বাস পাইনি। রাইড শেয়ারিংয়ে অ্যাপেও মোটরসাইকেল পাইনি। বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে যাচ্ছি।

মিরপুর এলাকার একজন পরিবহণ শ্রমিক জানান, সকাল থেকে কিছু সংখ্যক বাস নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমাবেশে যেতে দেখেছি। এছাড়া অন্য কোনো বাস চলাচল করেনি। দুপুরের পর গাবতলী থেকে কুড়িল হয়ে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটের কয়েকটি যাত্রীবাহী বাস চলাচল করতে দেখা যায়। পল্টনে সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়ায় সেগুলোও বন্ধ হয়ে যায়।

বড় দুদলের মহাসমাবেশ উপলক্ষ্যে ঢাকা-টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন মহাসড়ক এবং ঢাকায় প্রবেশপথ ও বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেকপোস্ট বসায়। আব্দুল্লাহপুর, উত্তরার পলওয়েল মার্কেট, বিএনএস সেন্টার, ধউর, আমিনবাজার, পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও র‌্যাবের চেকপোস্টে ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল আরোহীদের তল্লাশি করা হয়। যদিও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বহনকারী বিপুলসংখ্যক গাড়ি কোনো তল্লাশি ছাড়া ছেড়ে দেওয়া হয়।

মাওয়া পদ্মা সেতুর উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলমঙ্গীর হোসাইন জানান, জননিরাপত্তার কারণেই দূরপাল্লার বাস, মাইক্রো বাস, প্রাইভেট কার, সিএনজি ও মোটরসাইকেলে তল্লাশি চালাই। অস্ত্র ও নাশকতামূলক মালামাল বহন করা হচ্ছে কি না তা যাচাইয়ের জন্য এ তল্লাশি চালানো হয়। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় তল্লাশি চৌকিতে টঙ্গী পূর্ব থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এম সাফায়েত ওসমান বলেন, সমাবেশ উপলক্ষ্যে ঢাকায় ক্ষতিকর দ্রব্য ও বেআইনি অস্ত্র নিয়ে যাতে কোনো সন্ত্রাসী প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য তল্লাশি ও নজরদারি করা হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরায় আব্দুল্লাহপুরে তল্লাশি চালায় র‌্যাব। র?্যাব-১ এর ডিএডি এফএম ইমতিয়াজ আলী জানান, তল্লাশির আওতায় প্রাইভেটকার, মাইক্রো, সিএনজি, বাস, মোটরসাইকেল রয়েছে। এটা আমাদের নিয়মিত নিরাপত্তা তল্লাশি।

নৌকায় যাত্রী পারাপার বন্ধ : কেরানীগঞ্জ-সদরঘাট নৌরুটে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নৌকায় পারাপার হন। শনিবার এ রুটে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরেজমিন দেখা যায়, দুয়েকটি নৌকা চললেও এগুলো সদরঘাটের দিক থেকে কেরানীগঞ্জে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে। কেরানীগঞ্জের দিক থেকে ঢাকায় কোনো যাত্রী আনছে না। এতে ভোগান্তিতে পড়েন হাজারো যাত্রী। দেড় থেকে দুই মাইল ঘুরে বাবুবাজার ও পোস্তগোলা সেতু পাড়ি দিয়ে যাতায়াত করতে হয়েছে তাদের। মাঝিরা জানান, শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে নৌকা চলাচল বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নৌকা চলাচল বন্ধ রাখার জন্য নির্দেশ দিয়ে গেছেন। ওই কারণে মাঝিরা যাত্রী পারাপার করছেন না। মাঝি সামসু মিয়া বলেন, দুই-একটি বাদে কোনো নৌকা চলাচল করছে না বুড়িগঙ্গা নদীতে। আওয়ামী লীগ নেতাদের কথামতো আমরা নৌকা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।

এ বিষয়ে ঢাকা নৌকা মাঝি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমতাজুল হক মিন্টু বলেন, সব কথা আমি বলতে পারি না। আমি অনেক রিস্কের (ঝুঁকি) মধ্যে আছি। আপনি নিজ চোখে দেখতে পারবেন, কে বা কারা চলাচল বন্ধ করেছে।

টঙ্গীর তুরাগ নদে নৌযান চলাচল বন্ধ ছিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মাঝি বলেন, শুক্রবার রাতেই পুলিশ খেয়া নৌকা ও অন্যান্য নৌকা চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এ কারণে তারা নৌকা চালাচ্ছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে টঙ্গী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক হযরত আলী মিলন বলেন, নৌ-পথে আমাদের তল্লাশি চলছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নৌপথের যাত্রীদের দেহ তল্লাশি ও তাদের সঙ্গে থাকা ব্যাগে তল্লাশি করা হয়। তবে নৌকা চলাচল বন্ধের বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

লঞ্চ চলাচল করলেও সংখ্যায় কম : দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা থেকে শনিবার লঞ্চ ঢাকা নদীবন্দরে এসেছে। একই সময়ে লঞ্চ ছেড়েও গেছে। তবে তা আগের দিন শুক্রবারের চেয়ে কম ছিল। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা জানান, বিকাল ৬টা পর্যন্ত সদরঘাট থেকে ২৩টি লঞ্চ ছেড়ে যায় এবং ওই সময় পর্যন্ত ৪৫টি লঞ্চ ঘাটে পৌঁছায়। এর আগের দিন শুক্রবার একই সময় পর্যন্ত ৩৭টি লঞ্চ ছেড়ে গিয়েছিল ও এসেছিল ৬০টি।

তারা জানান, সদরঘাটে লঞ্চ আসার পরপরই পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত সন্দেহে অনেককে আটক করেছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/733955