২৮ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার, ৭:৩১

কাঁদো নদী কাঁদো

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

 

 

এখন থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে ১৯৬৮ সালে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ লিখেছিলেন তার অমর উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। একটি নদীর মৃত্যু নিয়ে চেতনাপ্রবাহ রীতিতে লেখা সে উপন্যাস পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। তাতে দেখানো হয়েছিল যে, একটি নদী মারা যাচ্ছে। স্টীমারঘাট সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। কারণ সেখানে পলি ভরাট হয়ে আর লঞ্চ বা স্টীমার ভিড়তে পারছে না। সুতরাং অনিবার্য কারণে ঘাট সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। বাঁকাল নদীর তীরে অবস্থিত কুসুমডাঙ্গা শহর। দীর্ঘকাল ধরে মানুষ এই স্টীমার ঘাটকেই কেন্দ্র করে নগর ও গ্রামের সংযোগ দেখেছে। চর পরে সেই নদীর এখন দুর্দশা।

খাদিজা এই উপন্যাসের একটি প্রধান চরিত্র। সে স্কুল শিক্ষিকা। কোমরভাঙা ধরনের হাঁটাচলা তার। কথা কম বলে একাকি হেঁটে স্কুলে যায়, ফিরে আসে। কেন যেন রটে গেল এই খাদিজা নদীর মৃত্যুর কান্না শুনতে পায়। এ নিয়ে নানা কানাঘুষা চলতে থাকে। কেউ কেউ তাকে অর্থহীন চ্যালেঞ্জ করে। খাদিজা জবাব দেয় না। শেষ পর্যন্ত গোটা কুমুদডাঙ্গায় রটে যায় যে, খাদিজা নদীর মৃত্যু যন্ত্রণার কান্না শুনতে পাচ্ছে। একবার এই রটনার ফলে এক ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হয়। নদী মরে গেলে কী হয়, তা নিয়ে মানুষের নানামুখী আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে তার চেহারা।

এখন সময় অনেক বদলে গেছে। রাজনীতি-অর্থনীতির কারণে নদী স্বাভাবিক গতি পথ হারিয়েছে। ভারত বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন ৫৪টি নদীর উপর বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করছে। প্রমত্তা পদ্মা শুকনো মওসুমে এখন ধূ ধূ বালুচর। হারিয়ে গেছে নদীগুলোর পরিবেশ-প্রতিবেশ। এই নদীকে ঘিরে কোটি মানুষের যে জীবন-জীবিকা ছিল তা বিলুপ্ত হয়েছে। শস্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। জেলেরা হারিয়েছে জীবনযাপনের অবলম্বন। সরকার শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এর কোনো জোড়ালো প্রতিবাদ করতে পারছে না। এখানে দেশপ্রেমের দারুণ অভাব। দেশ গোল্লায় গেলে যাক, আমার চাই ক্ষমতা, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা। এই মনোভাবের কারণে প্রতিনিয়ত আমাদের নদীগুলো মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে।

কিন্তু সুতীব্র দেশপ্রেম থাকলে কীভাবে যে নদী বাঁচানো যায় তার নজীর সৃষ্টি করেছিলেন জিয়াউর রহমান। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারত সরকার পদ্মার সিংহভাগ পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান সারা পৃথিবীর প্রভাবশালীদের একত্র করে ১৯৭৭ সালে ভারতকে পদ্মার পানি দিতে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বরণের পর, না এরশাদ সরকার না শেখ হাসিনা সরকার কেউ আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ভারত একতরফাভাবে এখনো পদ্মার পানির ন্যায্যহিস্যা বাংলাদেশকে দেয়নি। সরকারগুলো আর তেমন উচ্যবাচ্য করেনি।

আমাদের অবস্থাটা যেন এই যে পদ্মার পানি আর পাওয়া যাবে না। বর্তমান সরকার এমন একটা ভাব করল যে, তিস্তার পানি পাওয়া যাবে। তিস্তার পানির সঙ্গেও আমাদের দেশের প্রায় ৪ কোটি মানুষের ভাগ্য জড়িয়ে আছে। ভারত সরকার বলছে, এই তিস্তার পানিচুক্তি হলো বলে। তারা আমাদের কেবলই মুলা দেখায়। শেষ পর্যন্ত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এক যুক্তি বের করল যে, কেন্দ্রীয় সরকার তো তিস্তার পানি দিতেই চায়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জী সরকার তাতে রাজি হচ্ছে না বলেই তিস্তার পানি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ রকম শিশুতোষ যুক্তি বর্তমান সরকার মেনে নিয়েছে। মানুষ জীবন-জীবিকা হারাচ্ছে। অথচ ক’দিন আগে মমতা ব্যানার্জীকে বলতে শুনলাম বাংলাদেশকে তো আমরা পানি দিতেই চাই। কিন্তু এজন্য কেন্দ্রীয় সরকার ৭০০ কোটি রুপী দিতে চেয়েছিল, সেটাতো পাচ্ছি না। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে আমাদের চুক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে। রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের কি বিরোধ তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা চাই অবিলম্বে তিস্তার পানির ন্যায্যহিস্যা। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো সুরাহা না হলেও বাংলাদেশের বর্তমান ভারত-তোষণ সরকার ফেনি নদী থেকে ভারতকে পানি তুলে নেয়ার অনুমতি দিয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, কেউ খাবার পানি চাইলে তা না করি কীভাবে? এই দাস-মনোবৃত্তির অবসান ঘটাতেই হবে।

বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রধান সমস্যা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। এভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর পাড় ভাঙছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে বসতবাড়ি স্কুল কলেজ ও অন্যান্য স্থাপনা। নদীগুলো পানির অভাবে হেজেমজে শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। নদী হারিয়েছে তার গভীরতা। বর্ষায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা। শুকন মওসুমে খা খা মরুভুমি। দেশের নদনীদগুলো রক্ষায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। সরকারি দলের লোকের এই লুটেরা। সরকারের তরফ থেকে নদী রক্ষায় গালভরা বুলি শোনা যায়। কিন্তু নদী রক্ষায় চেষ্টা করে চাকরি হারায় কোনো কোনো কর্মকর্তা। 

গত শনিবার নেত্রকোনার দূর্গাপুরের সমেশ্বরী নদী নিয়ে একাধিক পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে লুট হয়ে যাচ্ছে সোমেশ্বরী নদী’। খবরটি পড়ে চোক ফেটে পানি এলো। এখন থেকে বছর পনেরো আগে বিরিশিড়ি বেড়াতে গিগে হেঁটে পার হয়েছিলাম সোমেশ্বরী নদী। ¯্রােত ধারার ভেতরে টল টলে ঠা-া পানি। উপর থেকে ভেসে আসছে কমল-মাঠ। নদীরপাড়ে কয়লার স্তূপ। কাঠ তুলে জড়ো করছে কেউ কেউ। জাল ফেলে মাছ ধরছেন অনেকেই। সেই নদীতে ছোট এক ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। খুবই সুস্বাদু।

এখন ইজারা নিয়ে নদী থেকে বালু তুলছে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই। কিন্তু মানা হচ্ছে না ইজারার শর্ত। এককালের চোখ জুড়ানো এই নদী রক্ষায় কারো কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। সেখানে শত শত অননুমোদিত বাংলার ড্রেজার কান ফাটানো শব্দে বালি তুলছে। দূষিত পরিবেশ দুর্বিষহ পরিসিস্থি নদীর বুক খুঁড়ে প্রতিদিন তুলে নেয়া হচ্ছে হাজার ট্রাক বালি নুড়ি পাথর আর কয়লা। বালু তোলার শ্রমিক ট্রাক চালক আর ইজারাদারের তদারকিতে নিয়োজিত লোকেরা ছাড়া অন্যাদের নদীর আশপাশে তেমন দেখা যায় না। সোমেশ্বরী নদীর সৌন্দর্য দেখতে এখন আর বেড়াতে আসে না কেউ। যে সোমেশ্বরীর পাড় এক সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সৌন্দর্য পিপাসু পর্যকটদের উপস্থিতিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠতো তার পাড় এখন পাহাড়া দেয় বালু দস্যুদের নিয়োজিত বিশেষ বাহিনী।

এক সময় স্থানীয় জেলেদের জীবীকার প্রধান উৎস ছিলো সোমেশ্বরীতে মাছ ধরা। স্থানীয়দের আয়ের আর একটি উৎস ছিলো পর্যটন। আমি যে বিড়িশিড়ি গিয়েছিলাম আমিও ছিলাম গৃহস্থ বাড়ির একটি ঘরে। এসব ঘর নিয়মিত ভাড়া দেওয়া হতো।

নদীর নাব্য রক্ষার জন্য ড্রেজিং-এর মাধ্যমে বালু তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো ২০০৫ সালে। কালক্রমে বালু দস্যুরা ড্রেজিংকে বালু তোলার হাতিয়ের হিসেবে ব্যবহার করে। ইজারা দেওয়া পাঁচটি বালু মহালের আয়তন প্রায় ২০০০ হাজার একর। নদীর প্রায় ২২ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বালু তোলা ও বালু পরিবহনের আয়তন চোখ পড়ে। ফলে এক সময়ের খর¯্রােতা নদী এখন সরু খাল রূপ নিয়েছে। মরে যাচ্ছে সোমেশ্বরী। 

এখানে আশার কোনো আলো নেই। একদিকে লুট হচ্ছে নদী অপর দিকে নদী রক্ষা কার্যক্রমকে মুখ থুবড়ে ফেলা হচ্ছে। দায়িত্ব পালনের মাঝপথে সরকার নদীরক্ষা

কমিশনের চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব পালনের মাঝখানে পদ থেকে সরিয়ে  দেয়া হয়েছে। এই কমিশন কেবল সরকারকে পরামর্শই দিতে পারতো। তাদের কোনো ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা ছিলো না। কমিশনের চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীকে জনস্বার্থে অপসারণ করা হয়েছে বলে সরকার দাবি করেছে। গত ২৪ সেপ্টেস্বর বিশ্ব নদী দিবন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জনাব চৌধুরী নাম উল্লেখ না করে শিক্ষামন্ত্রী দীপুমনির সমালোচনা করেন। আর সে কারণে চাকরি হারাতে হয় কমিশনের চেয়ারম্যানকে। এখন আর নদী মৃত্যু সংবাদও পাওয়া যাবে না।

https://www.dailysangram.info/post/539218