২৩ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ৬:৫৩

ডলার সংকটে বেপরোয়া মানি এক্সচেঞ্জ

 

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে ডলার সংকট চলছে দেশে। সংকটের এই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মানি চেঞ্জার বা মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। সব ধরনের নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা মজুত ও বিক্রি করে চলেছে তারা।

গত কয়েক মাসে বৈদেশিক মুদ্রার অবৈধ কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে বৈধ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নানা অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে পুলিশ ও বাংলাদেশ ব্যাংক।

অভিযানসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, নীতিমালা অনুযায়ী মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা রাখার সুযোগ নেই। তারপরও একাধিক অনুমোদনহীন অফিস খুলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক মানি চেঞ্জার। এমনকি স্টেশনারি দোকানেও চলছে বৈদেশিক মুদ্রার কেনাবেচা। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংককে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ও বিক্রির হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকাংশ মানি এক্সচেঞ্জ সঠিক হিসাব দিচ্ছে না।

অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)। গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তরায় দুটি মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রা উদ্ধার করে সংস্থাটি। ওই দিন উত্তরার লতিফ এম্পোরিয়াল মার্কেটের নিচতলায় আল-মদিনা ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার অ্যান্ড স্টেশনারি দোকানে অভিযান চালায় সিআইডি

স্টেশনারির ওই দোকানে বৈদেশিক মুদ্রার কেনাবেচা চলছিল। একই এলাকার কুশল সেন্টারের নিচতলায় মার্ক ন্যাশনাল মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশি মুদ্রাসহ ৪০টি দেশের ৮৮ লাখ ২ হাজার ২২৮ টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। তারা বাংলাদেশ ব্যাংককে মজুতের যে তথ্য দিয়েছে, তার সঙ্গে দোকানে থাকা মুদ্রার পরিমাণের মিল পায়নি সিআইডি। প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া তথ্যের কয়েক গুণ বৈদেশিক মুদ্রা মজুত করে রেখেছিল।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ দেশি মুদ্রা উদ্ধার করে। ছবি: ক্যানভা

সিআইডির একটি সূত্র জানিয়েছে, মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর দৈনিক ২৫ হাজার ডলার বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের অনুমোদন থাকলেও তারা এর বেশি মুদ্রা লেনদেন করে। নিয়ম অনুযায়ী তাদের রেজিস্টার খাতায় বেচাকেনা লিপিবদ্ধ করা উচিত, তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কোনো কিছু লিখে রাখে না।

অভিযানসংশ্লিষ্ট সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, মানি এক্সচেঞ্জগুলো তাদের ব্যবসার কোনো রেকর্ড রেজিস্টার খাতায় রাখছে না। তারা অবৈধভাবে ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে, আবার অবৈধভাবে বিক্রি করে। এ ছাড়া তারা সরকারনির্ধারিত দামে ডলার বিক্রি করে না। বেশি দামে ডলার বিক্রি করে।

এ বিষয়ে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন সিকদার আজকের পত্রিকা’কে বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে মুদ্রার দর বেঁধে দিলে তা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ডলার সংকটের মধ্যে মানুষ ডলার কিনতে দৌড়াচ্ছে, এর সুযোগ নিচ্ছে কেউ কেউ। আমরাও চাই এই সংকট কেটে যাক। যারা অবৈধ কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলুক।’

রেজিস্টার খাতায় হিসাব লিখে না রাখা নিয়ে হেলাল সিকদার বলেন, বৈধ প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন করার সুযোগ কম। ডলার লেনদেনের টালিখাতা মেইনটেইন করতে হয়। সবাই মানছে না, তা বলা যাবে না। তবে বলা যেতে পারে, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান মানছে না।

দেশে বৈধ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩৫। কিন্তু এর দ্বিগুণের বেশি অবৈধ মানি চেঞ্জার কার্যক্রমে আছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানের ৫ শতাধিক ঢাকায় ব্যবসা করছে।

জানা গেছে, গত তিন মাসে এমন বৈধ ও অবৈধ অন্তত ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সিআইডি। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধও করে দেওয়া হয়েছে।

সিআইডির সূত্র জানিয়েছে, গত তিন মাসে চলা অভিযানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আল ঈমান মানি এক্সচেঞ্জ, মতিঝিলের ওয়েলকাম মানি এক্সচেঞ্জ ও নীলফামারীর কেএন্ডকে এক্সচেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল মানি এক্সচেঞ্জ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

অনিয়মের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা করছে এমন ৬৫টি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের তথ্য পেয়েছে সিআইডি। সম্প্রতি অভিযান শুরুর পর গা ঢাকা দিয়েছেন অবৈধ প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা।

সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ সুপার (এসপি) মো. বাছির উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার অনেক অস্বচ্ছতা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করছি। কিছু প্রতিষ্ঠান এবং এর মালিকদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে।’

গত ২২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পল্টনের ‘শখ সেন্টারে’ অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় সিআইডি। অভিযানে চকবাজার মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড এবং বকাউল মানি এক্সচেঞ্জ নামের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের কাছ থেকে ইউএস ডলার ছাড়াও অন্যান্য পাঁচটি দেশের মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। চকবাজার মানি এক্সচেঞ্জের মালিক আহমেদ নোমান হলেও সেটি এখন এম এম জাকারিয়া নামের অপর এক ব্যক্তি পরিচালনা করছেন, যা অবৈধ। আর চকবাজার মানি এক্সচেঞ্জের একটি কাউন্টার পরিচালনার অনুমোদন থাকলেও তারা ৯টি কাউন্টার পরিচালনা করে আসছিল। প্রতিষ্ঠান দুটি বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রির কোনো রেজিস্টার খাতাও ব্যবহার করত না বলে জানিয়েছে সিআইডি।

সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, বৈধ ও অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের ওপর নজরদারি চলছে। সন্দেহজনক কিছু পেলেই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডলার কেনাবেচার ক্ষেত্রে কাউন্টারে বিনিময় হার প্রদর্শন করতে হবে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনায় এমনটাই বলা আছে। কিন্তু মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় একটি অংশই এই নিয়ম মানছে না।

নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ডলার কেনাবেচার অভিযোগে গত আগস্টের শেষ দিকে ৭ বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন স্থগিত করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ইয়র্ক মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, জামান মানি চেঞ্জিং হাউস, জেনি মানি এক্সচেঞ্জ, স্ট্যান্ডার্ড মানি এক্সচেঞ্জ লিমিটেড, মার্সি মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি লিমিটেড, জেবি মানি এক্সচেঞ্জ ও বেঙ্গল মানি এক্সচেঞ্জ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করেছিল, তাই তাদের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলোকে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতি মেনে ব্যবসা করতে হবে।

https://www.ajkerpatrika.com/298499