২১ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার, ১০:২৪

নতুন কারিকুলাম নিয়ে কেন এত শঙ্কা

 

আবিদ হোসেন, ফরিদপুরের একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আবিদের মা নিশাত তাসনিমের দুশ্চিন্তা ছেলেকে নিয়ে। তিনি বলেন, আবিদ আগে সন্ধ্যা হলে পড়তে বসতো। এখন পড়া একেবারেই কমে গেছে। নানা ধরনের অ্যাসাইন্টমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। তিনি এগুলোকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। কিন্তু তিনি বলেন, পড়ালেখা থেকে সম্পর্ক উঠে যাবার জোগাড়। তিনি বলেন, শিক্ষকদের স্পষ্ট ধারণা নেই কী পড়াতে হবে। কী করতে হবে। আর সেইসঙ্গে অল্প হলেও পরীক্ষার বিষয়টি থাকা উচিত। 

 

শিক্ষার্থীদের উপর চাপ কমানো ও মুখস্থ নির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করে সরকার।

এর প্রয়োগিক দিক থেকে নানা সমালোচনা চলছে। অভিভাবকদের একাংশ শিক্ষাক্রম সংশোধনের দাবি তুলে মানববন্ধনও করেছেন। অভিভাবকরা বলছেন, পরীক্ষা বহালকরণ, প্রাকটিক্যাল কাজ প্রতিষ্ঠানেই শেষ করা ও এর খরচ প্রতিষ্ঠানকে বহন করা প্রধান দাবি।

চলতি বছর চালু হয় নতুন শিক্ষাক্রম। ১ম, ২য়, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণি দিয়ে শুরু হয়েছে এর যাত্রা। আগামী বছর ৩য়, ৪র্থ, ৮ম এবং নবম শ্রেণিতে যুক্ত হচ্ছে। ২০২৫ সালে যুক্ত হবে ৫ম ও দশম শ্রেণিতে। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণিতে।

আরিফুল ইসলাম নামে এক অভিভাবক বলেন, এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে আগামী ১০ বছর পর অচল মানুষদের দিয়ে দেশ চালাতে হবে। যেখানে শিক্ষকরাই জানেন না কী করতে হবে?
বর্তমান শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থাকলেও নতুন এই শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যন্ত তা থাকছে না। শুধু মাত্র দশম শ্রেণির অভিন্ন বইয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা।

কারিকুলাম নিয়ে নানা শঙ্কা ও বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করে আসছেন অভিভাবকরা। বৃহস্পতিবারও মানববন্ধন করেছে অভিভাবকদের একাংশ। তারা চলতি বছর থেকে দেশে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাতিলসহ একাধিক দাবি জানান। ঘোষণা করেন বেশকিছু কর্মসূচি। এদিন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়। তাদের এ আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছেন শিক্ষকরাও। সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে এ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সারা দেশে স্কুলে স্কুলে একই কর্মসূচি পালিত হবে বলে জানা গেছে।

মানববন্ধনে অভিভাবকরা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে ৮টি বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রমে তাত্ত্বিক বিষয়ের চেয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নকে বেশি জোর দেয়া হয়েছে। নেই সাময়িক পরীক্ষাও। তারা বলছেন, পরীক্ষা পদ্ধতি না থাকায় ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়নমুখী হচ্ছে না। বইয়ের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় তারা ডিভাইসমুখী হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে সবচেয়ে বড় সমস্যা দলগত কার্যক্রমে। দেখা যাচ্ছে স্কুল থেকে প্রদত্ত দলগত কাজটি করতে হচ্ছে স্কুল পিরিয়ডের পর। যে কারণে ছাত্রছাত্রীদের বন্ধু-বান্ধবীর বাসায় বা অন্য কোথাও একত্রিত হয়ে তা সম্পন্ন করতে হচ্ছে। অধিকাংশ অভিভাবক স্কুল ছুটির পর তার সন্তানকে অন্য কারও বাসায় নিয়ে যেতে আগ্রহী নয় এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। অপরদিকে প্রজেক্টগুলোর সামগ্রী অপ্রতুল. দামও চড়া। এই উপকরণ গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য দুর্লভ। তারা বলছেন, গত ৯ মাসের বিভিন্ন জরিপ বলছে গ্রামের স্কুলগুলোতে এই শিক্ষাক্রম ১০ শতাংশও সফল হয়নি। এমতাবস্থায় এই শিক্ষাক্রম সংস্কার বা বাতিলের দাবি তাদের।

নতুন কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে ৮ দফা দাবি জানানো হয়েছে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে। দাবিগুলো হলো- নতুন কারিকুলাম সংস্কার বা বাতিল করতে হবে, ৫০/৬০ নম্বরে অন্তত ২ সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখতে হবে, নবম শ্রেণিতে বিভাগ রাখতে হবে, ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি ইন্ডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে। শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের সমস্ত ব্যয় স্কুলকে বহন করতে হবে এবং স্কুল পিরিয়ডেই সকল প্রোজেক্ট সম্পন্ন করতে হবে, শিক্ষার্থীদের দলগত কাজে ডিভাইসমুখী হতে অনুৎসাহিত করতে হবে এবং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে, প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, সকল শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রিপরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।

এসব দাবি বাস্তবায়নে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের পক্ষ থেকে বেশকিছু কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রতি স্কুলের সামনে মানববন্ধন, নতুন কারিকুলাম নিয়ে আলোচনা সভা, স্কুলে স্কুলে জরিপ কার্যক্রম, কারিকুলাম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক, ছাত্র-শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাবিদ, গবেষক, মন্ত্রী, মাউশি কর্মকর্তাদের নিয়ে কনফারেন্স/মতবিনিময় সভা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান, সম্মিলিত শিক্ষা কমিশন গঠন ও শিক্ষানীতির পূর্ণ প্রস্তাবনা সরকারের কাছে প্রেরণ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা পর্যায়ের একজন শিক্ষক বলেন, আমরা রীতিমতো বিপদের মুখে আছি। আমাদের যে প্রশিক্ষণ মিলেছে তা দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো যায় না। আমরা ঠিকমতো মূল্যায়ন করতে পারছি না।

তার ছেলে অধ্যয়ন করছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেয়ে নবমে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি সবথেকে বিপদে আছি মেয়েকে পড়তে বসতে বলতে হচ্ছে। আর ছেলেকে বলতেও পারছি না। তিনি বলেন, আমি আন্দোলনরত অভিভাবকদের দাবির সঙ্গে একমত। তবে আমি বাতিল না চেয়ে চাই সংশোধন করা হোক। হুট করে নতুন কারিকুলাম না এনে আমাদের আগে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন ছিল। আর এই কারিকুলামের সংশোধন প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, এই কারিকুলামটা বিদেশি কারিকুলাম অনুসরণ করতে যেয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, দেশের শিক্ষকদের অবস্থা, অভিভাবক-স্কুলের অবস্থা চিন্তা করা হয়নি। এই কারণে এটা দেশের জন্য অনুপযোগী। তবে এই কারিকুলামকে আমি ভুল বলছি না, এটা অনুপযোগী। 

তিনি আরও বলেন, এই কারিকুলাম অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। যা বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। এটি অনুসারে বইপত্র লেখাও একটা চ্যালেঞ্জ। এবার বই নিয়ে কতো হইচই। সামনের বছর আরও বই আসছে। এই কারিকুলাম অনুযায়ী বই লেখার যোগ্যতা সম্পন্ন লেখকও নাই আমাদের। আর মূল্যায়ন তো একেবারেই যাচ্ছেতাই। যারা করেছেন কারিকুলাম, তাদের কাছেও স্বচ্ছ ধারণা আছে বলে মনে হয় না।

https://mzamin.com/news.php?news=79524