২১ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার, ১০:১১

নিয়ন্ত্রণহীন নিত্যপণ্যের বাজার সংসারের খরচে কাটছাঁট

https://www.dailysangram.info/post/538597

এখনো নিয়ন্ত্রণহীন নিত্যপণ্যের বাজার। সরকার নানা চেষ্টা করেও একটি পণ্যের দামও কমাতে পারেনি। ডিমের হালি ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা, আলুর কেজি ৫০ টাকা, ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজির কমে কোন ধরনের সবজি মিলছে না। ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। আর মাছের দামও আকাশচুম্বী। অল্প আয়ের মানুষের দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতেই চলে যাচ্ছে আয়ের সিংহ ভাগ। যার কারণে অন্যান্য ব্যয় মেটানো কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মানুষের। আর এ জন্য সংসারের সকল খরচে কাটছাঁট করে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণপনে চেষ্টা চালাচ্ছেন অল্প আয়ের মানুষেরা। তাদের আয়ও বাড়ছে না, আবার জিনিসপত্রের দামও কমছে না। সবমিলিয়ে উভয় সংকটে। অবিলম্বে বিশেষ নজরদারির মাধ্যমে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন ক্রেতারা।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, এক সপ্তাহে প্রতি হালি ডিমের দাম পাঁচ টাকা বেড়ে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ডিমের ডজন বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। সাধারণ মানুষের একটি ডিম খেতে গুনতে হচ্ছে ১৫ টাকা। অথচ সরকার প্রতি পিস ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া আরেক পণ্য পেঁয়াজ। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি যার দাম বেড়েছে ১০ টাকা পর্যন্ত। এখন দেশি ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। আর আমদানি করা পেঁয়াজ ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

এদিকে সবজির বাজারে বেশিরভাগ সবজি কেজিতে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গোল বেগুন ১০০ থেকে ১২০ টাকা, লম্বা বেগুন ৮০ টাকা, কাঁচামরিচ ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, করলা ৯০ থেকে ১০০ টাকা, কচুমুখী ৯০ থেকে ১০০ টাকা, ঢেঁড়স-পটল-চিচিঙা-ঝিঙা-কাঁকরোল ৮০ টাকা, গাজর ও টমেটো ১০০ থেকে ১২০ টাকা, শিম ১৮০ থেকে ২০০ টাকা, পেঁপে ৩০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মাছের বাজারও চড়া। এক কেজি সাইজের রুই মাছ ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এক কেজির ওপরেওগুলো বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে। সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে পাঙ্গাস মাছ। এই মাছ ১৯০-২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

স্বস্তি নেই মুরগির বাজারেও। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৯০ থেকে ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গরুর গোশত ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি, আর খাসির গোশত ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি।

নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দামের কারণে সংসারের খরচে কাটছাঁট করতে হচ্ছে অল্প আয়ের মানুষের। তেমনই একজন অল্প আয়ের মানুষ আলতাফ। তিনি দোকানে দোকানে বহুজাতিক একটি কোম্পানির পানির বোতল সরবরাহ করে দিনশেষে আয় করেন ৪ থেকে ৫শ টাকা। এতে তার মাসিক আয় দাঁড়ায় ১৫ হাজার টাকার মতো। ব্যয়বহুল ঢাকা শহরে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে থাকতেই আলতাফের আয়ের বেশিরভাগ অংশ চলে যায়। সঙ্গে বড় মেয়ে ও মেয়ের জামাইও থাকেন। প্রতিমাসে তাদেরও টুকটাক সহযোগিতা করতে হয়। এরমধ্যে ঘর ভাড়া তো আছেই। ফলে কোনোমতো খেয়ে-পরে বাঁচতে ঊর্ধ্বমুখী দ্রব্যমূল্যের বাজারে সংসারের খরচ অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন আলতাফ। 

তিনি জানান, গত কুরবানির সময় স্থানীয় লোকজন বাসায় গোস্ত দিছিল, সেইটা দুই দিন খাইছি। এরপর থেকে আর গরুর গোস্ত কিনতে পারিনি। প্রতি মাসে খরচ হতো ১২ হাজার টাকা। কিন্তু গত কয়েক মাসে বাজারে দর চড়া, হিমশিম খাচ্ছি। আগে প্রতিদিন গড়ে হাতে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা থাকত। এখন সেটা একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্টো কয়েক মাস থেকে ধার-দেনা করে সংসার চালাচ্ছি। সংসারের মাসিক বাজার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছি।

আলতাফ আরো জানান, আগে প্রতিদিন সকালে রুটি বানাতে তার প্রায় এক কেজি আটা লাগতো। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে বাদ যায়নি আটাও। তাই আধা কেজি আটায় তৈরি রুটিতেই সকালের নাস্তা সারেন তারা। মাছ-গোশত আগে মাঝে-মধ্যে জুটলেও এখন একদমই কিনতে পারছেন না।

শুধু আলতাফই নয়, তার মতো ঘনবসতিপূর্ণ এ নগরীর খেটে খাওয়া হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষেরও একই দশা। নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া হয়ে যাওয়ায় খাবার কিনে খাওয়াই যেন তাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে। অনেকের আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। আবার চাল আনতেই কারও কারও ডাল-সবজি কেনা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

রাজধানীর বাজারে দেখা গেছে, নিত্যপণ্যের লাগামহীন দর বাজারে ক্রেতাদের অবস্থান তিন ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ দামি সবজি কিনছেন অনায়াসে। ২০০ টাকা কেজি দরের শিমও বিক্রি হচ্ছে। থেমে নেই ৪০০ টাকা কেজি দরের ক্যাপসিকাম, ১৮০ টাকার বিট রুট বিক্রি। বিক্রেতাদের মতে সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষ এসব সবজির মূল ক্রেতা। আর মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সবজি যেন ভিন্ন। তারা কিনছেন ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরের করলা, কাকরোল, ঝিঙা, চিচিংগার মতো সবজি। আবার সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষের সবজি হয়ে উঠেছে পেঁপে। রাজধানীর বাজারে একমাত্র পেঁপেই মিলছে কম দামে। কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে।  নগরের ছোট খাবার হোটেলের গুরুত্ব বেড়েছে পেঁপের।

বিক্রেতাদের মতে, ছিন্নমূল মানুষের খাবারের পাতে পেঁপের জায়গাই যেন বেশি। আবার এক থেকে দুই দিনের পুরনো সবজির দিকেও ঝোঁক আছে দরিদ্র মানুষের।

এক সবজি বিক্রেতা জানান, আমগো পুরান সবজি আমরা সন্ধ্যায় বিক্রি কইরা দেই। আলাদা দোকানদার আছে। তারা কিনা নেয়। পচা, পোকায় খাওয়া অংশ বাদ দিয়া তারা বিক্রি করে।'

সেক্ষেত্রে সবজির দাম নেমে আসে চার ভাগের এক ভাগে। এছাড়া সবজি ‘ভাগা’ দিয়েও বিক্রি করতে দেখা গেছে কিছু বিক্রেতাকে।

ব্রয়লারের বাজারেও ক্রেতাদের অবস্থান ত্রিমুখী। কেউ কিনছেন পাকিস্তানী কক আর সোনালি মুরগি। যা বাজারের সর্বোচ্চ দামি মুরগির জায়গা দখল করে আছে। মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কিনছেন ১৯০ টাকা কেজির ব্রয়লার।

তাদের বাইরেও রয়েছে আরেক শ্রেণির ক্রেতা। যারা দরিদ্র ও দিনমজুর। মাসে একদিন আস্ত মুরগি কেনার সামর্থ্য হয় তাদের। বাকি সময় চলে মুরগির পা, পাখনা, গিলা-কলিজা দিয়ে। পোশাক শ্রমিক সফুরা তাদের একজন। তিনি বলেন, ‘ইনকাম কম ভাই। সব কিছুর দাম বেশি। এখন গার্মেন্টসে ওভারটাইমও নাই। সারাজীবন আস্তা মুরগিই কিনছি। যা জীবনে খাই নাই, এহন তাই কিনি। মুরগির পা তো জীবনে বাসায় নেইই নাই। এহন ওইগুলাই রাইন্দা খাই।'

ব্রয়লার বিক্রেতা নাজিম জানান, আগে মানুষ দেখতাম বিড়ালরে খাওয়ানোর জন্য গিলা-কলিজা, পা, হাড্ডি নিতো। এখন অনেকে নিজেরা খাওয়ার জন্য নেয়। বাজারে বর্তমানে মুরগির গিলা-কলিজা ১৩০ টাকা কেজি, শুধু পা ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ধনাঢ্য অনেকেই হাড় ছাড়া গোশত পছন্দ করেন। তারা শুধু গোশত নিয়ে হাড় ফেলে যান। সেই গোশত ছাড়া মুরগির শুধু হাড় বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা কেজি দরে। 

বিক্রেতারা জানান, দরিদ্র মানুষগুলো এই হাড় নিয়েই মাংস হিসেবে রান্না করেন। গোশত হিসেবে পরিবারের সদস্যের পাতে তুলে দিচ্ছেন হাড়।

সমাজের ধনী দরিদ্র মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত ডিমের বাজারে। শুক্রবার লাল ডিম ৫৫-৫৭ টাকা হালি বিক্রি হতে দেখা গেছে।

হালিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বাঁচাতে ভাঙা ডিম কিনতে দেখা গেছে এক শ্রেণির মানুষকে। ভাঙা ডিমের হালি ৪০ টাকা। বিক্রেতাদের মতে, গৃহকর্মী, দিনমজুর শ্রেণির মানুষ এই ডিমের ক্রেতা।