২১ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার, ১০:০৬

রিজার্ভ রক্ষায় নীতি-নেতৃত্বের সমন্বয়

-ড. মো: মিজানুর রহমান

 

ভালো রিজার্ভ থাকলে দেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ থাকে না। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে প্রায় আট মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যেত। তার আগে যেভাবে বাড়ছিল তাতে রিজার্ভ এত দিনে ৬০ বিলিয়ন ডলারে ওঠার কথা। না হয়ে বরং ৫৫ শতাংশ কমে ২১ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের হিসাবে প্রকৃত রিজার্ভ মাত্র ১৮ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে সর্বোচ্চ তিন মাসের দায় পরিশোধ করা সম্ভব। এ অবস্থায় আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় করা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। 

গত দুই বছরে প্রতি মাসে রিজার্ভ কমেছে এক বিলিয়ন ডলার করে। ডলার আয়ের প্রধান দু’টি পথ সঙ্কীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে প্রতি মাসে দুই বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় আসত। এখন আসে গড়ে দেড় বিলিয়ন ডলার। রফতানি আয় বাড়ছে না। নানা ব্যবস্থা নিয়েও রিজার্ভ বাড়ানো যাচ্ছে না। রিজার্ভ কমে যাওয়ার এই প্রবণতা অনেক বেশি ভয়ের। তার ওপর বিদেশী ঋণের সুদ ও কিস্তি শোধের চাপও বাড়ছে।

এ পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংকগুলোর প্রবাসী কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়িয়ে রিজার্ভ সমৃদ্ধ করা দরকার। ব্যাংকগুলো তা না করে উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার জন্য বসে থাকছে এবং তারা পাচ্ছেও। এতে ঝুঁকি বাড়ছে রিজার্ভে। এই সঙ্কট শিগগির কাটার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

 

রিজার্ভের গঠন, কমার কারণ ও বাড়ানোর উপায়
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় থেকে ব্যয় মিটিয়ে চলতি হিসাবে যে উদ্বৃত্ত থাকে তা-ই রিজার্ভ। রিজার্ভ বাড়ানোর পথ হলো, চলতি হিসাবের ঘাটতি কমানো, অথবা আর্থিক হিসাবে সঞ্চয় বাড়ানো, অথবা এ দু’য়ের মিলিত পদক্ষেপ। এর জন্য কৌশল হলো, আমদানি কমানো; রফতানি বাড়ানো; প্রবাসী আয় বাড়ানো; বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানো; আমদানির চেয়ে বেশি রফতানি; বাণিজ্য ঘাটতির চেয়ে রেমিট্যান্স বেশি বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যিক সেবা খাতের ব্যয় কমিয়ে আনা বা আয় তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ানো ইত্যাদি। বিলাসদ্রব্যের আমদানি কমালে দেশের মঙ্গল। তবে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি কমালে রফতানি আয় এবং শেষতক জাতীয় আয় কমে যায়। 

দেশের ডলার সঙ্কট মোকাবেলায় আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যয় সঙ্কোচন, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে অর্জিত মুনাফা দেশে পাঠানো বন্ধ ও অনেক ক্ষেত্রে টাকায় রয়্যালটি প্রদানের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিদেশী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া দেশী ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ডলারে পেমেন্ট এড়ানোর জন্য ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগকারীদের পেমেন্ট বাকি রাখা ছাড়াও বিদেশ থেকে বাকিতে জ্বালানি কিনছে সরকার। গাড়ি কেনা ও বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করার ঘোষণা এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জ্বালানি তেল, সার, অতি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য কেনাকাটায় দেখেশুনে ব্যাংকগুলোকে কিছু ডলার সরবরাহ করছে।

এত পদক্ষেপের পরও রিজার্ভ বাড়ছে না, কারণ, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছিল ৮২ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের। ফলে সার্বিক ভারসাম্য ৬ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণাত্মক হয় যা টানতে হচ্ছে এবং ঘাটতির পরিমাণ বেড়েই চলছে। বিশ্বজুড়ে মুদ্রাস্ফীতির কারণে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ হারে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কথা থাকলেও বাস্তবে বাড়ছে ৩২ শতাংশের বেশি। আবার ব্যাংকের হিসাবে যে পরিমাণ রফতানি দেখানো হয়েছে সে পরিমাণ রফতানি আয় আসেনি; ৯ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রয়েছে।

রিজার্ভ রক্ষায় নীতি ও নেতৃত্ব
নীতির ভুলে সঙ্কট আরো ঘনীভূত হয়েছে। প্রথমত সরকার তাদের সফলতা প্রকাশ করতে গিয়ে রিজার্ভ সম্পর্কে জনমনে এমন অনেক ভুল ধারণা দিয়েছে যে, মানুষের মনে ধারণা হয়েছিল- রিজার্ভ অলস পড়ে আছে। যার কারণেই রিজার্ভ থেকে অবকাঠামোর জন্য তহবিল করা হয়েছিল। এমনকি সরকারের রাজনৈতিক ইমেজ বাড়ানোর জন্য রিজার্ভের টাকা থেকে শ্রীলঙ্কাকে ঋণও দিয়েছিল। অর্থাৎ, ফলস সেন্স অব প্রাইড তৈরি করা হয়েছিল রিজার্ভ নিয়ে। ফলে অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

২০২১ সাল পর্যন্ত ডলারের রিজার্ভ যখন বাড়ছিল তখন বিশ্ববাজারের আনুষঙ্গিক বিষয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়নি। এমনকি রিজার্ভ কমতে শুরু করার পরও ডলারের দাম পরবর্তী এক বছর প্রায় স্থির রাখা হয়। পরিস্থিতির চাপে হারের পরিবর্তন শুরু করে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে। এখনো রিজার্ভ কমছে অথচ তা বাড়ানোর জোরালো উদ্যোগ না নিয়ে বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে। অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রিজার্ভ কমছে, তবু ডলার বিক্রি করার মানে হয় না। 

২০২৩ সালের পুরো সময় ডলার সঙ্কট থাকবে এমন আভাস চলতি বছরের শুরুতেই দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। পরিস্থিতি এখন সেই বার্তাই দিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চাল, ডাল, তেল ইত্যাদি আমদানি করতেই হবে। এতে রিজার্ভের আরো ঘাটতি সৃষ্টি হবে।’ নির্বাচনের আগে রিজার্ভ বাড়ানোর তেমন কোনো উপায় থাকছে না বলে স্বীকার করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। 

শর্ত পূরণ না হওয়ায় আইএমএফের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি যদি সময়মতো পাওয়া না যায় তাহলে রিজার্ভ পরিস্থিতি নাজুক হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাব, ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদল, ডলার কারসাজির সাথে জড়িতদের শাস্তি না দেয়া, ডলারের প্রতিযোগিতামূলক দাম না দেয়া, প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করতে না পারা, সঙ্কটে বিশেষজ্ঞদের মতামত আমলে নিতে গড়িমসি ইত্যাদি কারণ সঙ্কট চরমে উঠেছে।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা ড. সাদিক আহমেদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন গত ছয় বছরের ভুলের মাশুল দিচ্ছে। এখন সংশোধন করতে শুরু করেছে তবে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তারপরও সংস্কার করতে হবে। 

সঙ্কটের মধ্যে আরো সঙ্কট যেন আকুর সাম্প্রতিক লেনদেনে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত। এর ফলে বাংলাদেশকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার নগদে পরিশোধ করতে হতে পারে সামনে, যা আগে দুই মাস পর পর দেয়ার সুযোগ ছিল। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপও সঙ্কট বাড়িয়ে দিচ্ছে। অতীতের বিভিন্ন দেশের ও সংস্থার ঋণের সুদ ও কিস্তি শোধের চাপও বাড়ছে। সঙ্কটের আরো একটি কারণ শোনা যায়। সেটি হলো অর্থের সাথে অর্থমন্ত্রীর তেমন সংশ্লিষ্টতা না থাকা। সর্বোপরি সরকারের অনেক পদক্ষেপ বা সঙ্কোচন নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। 

রিজার্ভ রক্ষায় সমন্বিত প্রচেষ্টা
কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের দোহাই দিয়ে আর পার পাওয়া যাচ্ছে না; বরং এই সঙ্কট দেশের অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কারণে হয়েছে- এই সত্যি স্বীকার করে, ভুলগুলো শনাক্ত করে তা সমাধানের সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। রিজার্ভ কমে যাওয়ার মূল কারণ স্বাভাবিক নয়; বরং সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সৃষ্ট ব্যর্থতা এবং যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। এর জন্য প্রথমত, দেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি হতে হবে চৌকস। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিশ্বমানের গভর্নর প্রয়োজন। দেশের অর্থমন্ত্রী, গভর্নর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতিগুলো অর্থশাস্ত্রসম্মত স্বাভাবিক ও সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহারের সমন্বয় করতে হবে। অর্থব্যবস্থার অব্যবস্থা দূর করে ঋণমান পজিটিভ করতে হবে। বাণিজ্যের আড়ালে অর্থপাচার, গোষ্ঠী ও সঙ্কীর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থান্বেষী মহলের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে; হুন্ডি ও হাওলা বন্ধ করতে হবে। এই সব কিছুর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। 
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
Mizan12bd@yahoo.com

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/785608