২০ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:৫৯

দাম বেঁধে দেয়ার সরকারি নির্দেশনার এক মাস

উল্টো বেড়েছে পণ্যের দাম

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পর পেঁয়াজ, ডিম, আলুর দাম কমেনি বরং আরো বেড়েছে

দুর্গাপুজা উপলক্ষ্যে ভারত ইলিশ চেয়েছিল সে ইলিশের চালান কোলকাতায় চলে গেছে। কিন্তু সংকটময় মুহুর্তে বাংলাদেশ ভারতের কাছে ডিম চাইলেও গত দুই সাপ্তাহেও তা দেয়নি ভারত। বাংলাদেশে ডিমের দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। গরীবের আমিষের চাহিদা মেটানো ডিম এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম। কয়েকটি কর্পোরেট হাউজ সিÐিকেট করে ডিমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাজারে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে স¤প্রতি তিন দফায় ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অনুমতি পাওয়ার এক মাসে একটি ডিমও আমদানি হয়নি। ফলে দাম তো কমেইনি, উল্টো বেড়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, ডিমের বাজারে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করায় ৬ কোম্পানি ও ৪ বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। মজার ব্যাপার হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, প্রতিদিন ডিমের চাহিদা চার কোটি পিস। উৎপাদনকারীরা সংবাদ সম্মেলনক করে দাবি করেছেন প্রতিদিন ডিম উৎপাদনক হয় ৫ কোটি পিস। প্রতিদিন এক কোটি পিস ডিম অতিরিক্ত উৎপাদন হলেও দাম কেন আকাশছোঁয়া হলো সেটাই হলো রহস্য।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয়। এর পরপরও পর্যায়ক্রমে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশ (কার্যত ভারত) ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। এখন বলা হচ্ছে, শর্তপূরণ ও অতিরিক্ত কর, পূজার ছুটিসহ নানা রকম জটিলতায় ডিম আমদানি করা যাচ্ছে না। তাই তারা আমদানিতে ঢিলেমি শুরু করেছে।

ডিম আমদানির অনুমতি প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের দাবি বাংলাদেশের আমদানির খবরে ইতোমধ্যেই ভারতে ডিমের দাম বেড়ে গেছে। আর ডিমের ওপর ৩৩ শতাংশ শুল্ক থাকায় দেশের বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করা নিয়েই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে চিন্তাভাবনা করেই ডিম আমদানি করবেন আমদানিকারকরা। সব মিলিয়ে এক মাস আগে ডিম, আলু ও পেঁয়াজ নিয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। আলু ও পেঁয়াজের বেঁধে দেওয়া দাম মানেননি ব্যবসায়ীরা। এখন ডিম আমদানিতেও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ২১ সেপ্টেম্বর আরও ছয় প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় হয়। তৃতীয় দফায় গত ৮ অক্টোবর আরো পাঁচ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। গত ২ অক্টোবর থেকে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমদানি অনুমতিপত্র দিচ্ছে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর।

আমদানিকারকরা বলছেন, গত ২ অক্টোবর আমদানিকারকদের আইপি দেওয়া হয়েছে। এখন এলসি খুলে ডিম আমদানি করতে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ সময় লাগবে। তবে সংকট হয়েছে অন্য জায়গায়। বাংলাদেশের আমদানির খবরে ভারতে ডিমের দাম বেড়ে গেছে। তারা বলছেন, বর্তমানে ভারতে প্রতিটি ডিমের দাম এখন ৫ দশমিক ৭০ রুপির আশেপাশে। আমদানির অনুমতি পাওয়ার আগে ছিল ৪ দশমিক ৮০ থেকে ৪ দশমিক ৯০ রুপি করে। আর ডিম আমদানিতে যে এইচএস কোডটি ঠিক করা হয়েছে, সেটিতে শুল্ক–করের হার ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য আমদানিতে ৩৩ টাকা রাজস্ব আয় হবে সরকারের।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভারতের বাজারে ডিমের যে দাম, তাতে বাংলাদেশে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিটিতে দুই টাকার মতো রাজস্ব পাবে সরকার। সেই হিসাবে প্রতিটি ডিম বাংলাদেশে আসতে খরচ পড়বে কমপক্ষে সাড়ে ১০ টাকা।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করা শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ডিম আমদানির অনুমতিপত্র (আইপি) পেয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। আশা করছি শিগগিরই আমদানি করা ডিম বাজারে আসবে। তখন দাম কিছুটা কমবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ি পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন করে ডিমের বাজারে অস্থিরতা। শেষ এক সপ্তাহে প্রতি হালি ডিমের দাম পাঁচ টাকা বেড়ে ৫৫ থেকে ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বড় বাজার থেকে কিনলে ডিমের ডজন (১২টি) পড়ছে ১৬০ টাকা, আর পাড়া-মহল্লার খুচরা দোকানে ১৭০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। ক্রেতাকে একটি ডিম খেতে গুনতে হচ্ছে ১৪ টাকা। অথচ সরকার প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে বাজারে ডিমের দাম বেড়েছে। যখন দাম বেঁধে দেওয়া হয়, তখন বাজারে প্রতি হালি ডিমের দাম ৫০ থেকে ৫৩ টাকার মধ্যে ছিল, যা এখন ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা হলে খুচরা বাজারে তা ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। সেই হিসাবেও এক হালি ডিমের দাম হয় ৪৮ টাকা। কিন্তু বাজারে তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করতে শুরু থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় সারা দেশে গড়ে একশর মতো প্রতিষ্ঠান জরিমানা গুনছে বেশি দামে এসব পণ্য বিক্রি করায়। এ ছাড়া ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এসব নানামুখী তৎপরতার পরও এই এক মাসে বাজারে পণ্যটির দাম কমেনি, বরং বেড়েছে।

গত আগস্টে এক ডজন ডিমের দাম ১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় ‘সিন্ডিকেটের’ মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণকে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো প্রতিটি ডিমের মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করে দেয়।

এরপর তিন দফায় ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। অনুমতির এক মাস পার হলেও এ পর্যন্ত আমদানির কোনো ডিম দেশে আসেনি। দর বেঁধে দেওয়ার এক মাস পরও বাজারে তা কার্যকর করা যায়নি। খুচরা বাজারে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়।

বেঁধে দেওয়া এ দর যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় প্রথম দফায় গত ১৮ সেপ্টেম্বর চার প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- মীম এন্টারপ্রাইজ, প্রাইম এনার্জি ইমপোর্টার্স অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স, টাইগার ট্রেডিং ও অর্ণব ট্রেডিং লিমিটেড। দ্বিতীয় দফায় ২১ সেপ্টেম্বর আরো ছয় প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি করে ছয় কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

https://dailyinqilab.com/national/article/611029