১৮ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ২:৫৪

দেশে কোটিপতি এবং ভিক্ষুকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে

-এম এ খালেক

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে প্রতীয়মান হয়েছে যে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক কোটি টাকা এবং তদূর্ধ্ব অঙ্কের আমানত আছে এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন মাসে বেড়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার। এসব অ্যাকাউন্টধারীদের দখলে রয়েছে ব্যাংকিং সেক্টরের মোট আমানতের ৪৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এ বছর মার্চ প্রান্তিকে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের মোট অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ১১ লাখ ৩৭ হাজার ২৫৬টি। এতে জমা ছিল ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা। এক কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব টাকার অ্যাকাইন্টের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ১৯২টি। তিন মাসের ব্যবধানে কোটি টাকার অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৩৬২টি। আর এক বছরের ব্যবধানে এটা বেড়েছে ৫ হাজারটি। তবে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলছেন, কোটি টাকার অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত প্রাতিষ্ঠানিক জমা বৃদ্ধি পাবার কারণে। অর্থাৎ দেশের ব্যক্তি মালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের উপার্জিত অর্থ নানাভাবে ব্যাংকে জমা রাখছেন। যেহেতু দেশে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ নেই। তাই উদ্যোক্তাগণ তাদের নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে তা কোনোভাবেই স্থানীয় এবং বিদেশী বিনিয়োগ আহরণের জন্য অনুকূল নয়। তাই এই মুহূর্তে উদ্যোক্তাগণ নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ অনুসরণ করে চলেছে। চলতি অর্থ বছরের জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপি’র ২৭ শতাংশে উন্নীত করা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার হচ্ছে জিডিপি’র ২৩ শতাংশের কিছুু বেশি। সাম্প্রতিক বছরগুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো একক বছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার এক শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়নি। তাই চলতি অর্থ বছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপি’র ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় বৃদ্ধি না পেলেও ব্যাংক ঋণ প্রবাহ কিন্তু ঠিকই বাড়ছে।
আগের মুদ্রানীতিতে ব্যক্ত খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। গত বছর আগষ্ট মাসে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। কিন্তু শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। তাহলে ব্যাংক থেকে যে ঋণ মঞ্জুর ও ছাড়করণ করা হয়েছিল তা কোথায় গিয়েছে? অথবা কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে এ প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে।

আমাদের দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে এটা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। নব্য কোটিপতি বা আগে থেকেই যারা কোটিপতির তালিকায় আছেন তাদের সম্পদের পাহাড় ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। এই অর্থ কি তারা বৈধভাবে উপার্জন করেছেন করেছেন নাকি অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন? আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকগণ মুখে অনেক সুন্দর কথা বলেন কিন্তু কাজের বেলায় ফক্ফকা। সরকারিভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের কথা বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে। কিন্তু ‘জিরো টলারেন্স’ শব্দটি এখন উপহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছে। সরকারি নীতির শৈথিল্যের কারণে দেশে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে চলেছে।

এখন সব পর্যায়েই শিষ্টের দমন আর দুষ্টের পালন চলছে। কোনোভাবেই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে কেউ যদি ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকেন তাহলে শত দুর্নীতি করেও তার কিছু হচ্ছে না। সম্প্রতি এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রাক্তন সচিবের বেশ কয়েকটি বাড়ি এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আরো অন্তত দেশ শত বাংলাদেশির সম্পদের উৎস অনুসন্ধান করা হচ্ছে। একজন সচিব তিনি যত ক্ষমতাবান হোন না কেনো তিনি যদি সৎভাবে জীবন যাপন করেন তাহলে নিজস্ব স্ট্যাটাস বজায় রেখে তার সংসার চালানোই কঠিন। তিনি কি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একাধিক বাড়ি ক্রয় করেন? বিভিন্ন সময় বিদেশে বাংলাদেশিদের যে অবৈধ সম্পদের খবর পাওয়া যায় কিছুদিন আলোচনার পর তা স্তিমিত হয়ে যায়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আছে তারা এসব দুর্নীতিবাজ দেশদ্রোহীদের শাস্তি দানের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী সেদিন প্রসঙ্গক্রমে বলছিলেন, বর্তমানে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ ‘টাকা খাপাচ্ছেন।’ বিশেষ করে সরকারি দলের সমর্থকরা এই কাজ করছেন। আমি বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বললেন, যারা অবৈধভাবে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তাদের সবার পক্ষে বিদেশে অর্থ পাচার করা সম্ভব হয় না। এরা নিজেদের উপার্জিত অর্থ স্বনিয়ন্ত্রণে রাখেন। এই টাকা তারা ব্যাংকের সঞ্চয় করেন না। কারণ তাহলে তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে যে কোনো সময় প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। এছাড়া কোনো কারণে নির্বাচনে তাদের সমর্থিত দলের পরাজয় ঘটলে বিপদ ঘটতে পারে। তাই তারা উপার্জিত অর্থ বাড়িতেই সংরক্ষণ করছেন। তারা জানেন, সরকার পরিবর্তন না হলে তাদের বাড়িতে কেউ হানা দেবে না। তারা বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থ বাড়িতে সংরক্ষণ করেন না। তারা টাকাকে মার্কিন ডলারে কনভার্ট করে তা সংরক্ষণ করেন। এতে তুলনামূলক কম স্পেসে বেশি পরিমাণ টাকা সংরক্ষণ করা সম্ভব। তিনি দাবি করেন, বর্তমানে বাজারে মার্কিন ডলারের যে সঙ্কট চলছে তাদের পেছনে এই অবৈধ অর্থ সংরক্ষণকারীদের অবদান রয়েছে। ভদ্রলোক যে তথ্য দিলেন তা তদন্তযোগ্য।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার কোনো নতুন ঘটনা নয়। উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশ থেকেই অর্থ পাচার হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয় উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশ থেকে। উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের এক শ্রেণির মানুষ তাদের রাজনৈতিক এবং অন্যান্য ক্ষমতা ব্যবহার করে বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলছেন। সেই অর্থ যেহেতু দেশে প্রশ্নাতীতভাবে ব্যবহারের সুযোগ নেই তাই তারা বিদেশে পাচার করে দেন। যে অর্থ নিজ দেশের উন্নয়ন এবং জনস্বার্থে ব্যবহৃত হতো পারতো তা বিদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা জঘন্য অপরাধ। এটা দেশদ্রোহীতার সামিল। বিশ্বের অনেক দেশেই অবৈধ সম্পদ নিয়ে গেলে তা প্রশ্নাতীতভাবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। ফলে উন্নয়নশীল দেশের এক শ্রেণির মানুষ তাদের অবৈধ উপার্জিত অর্থ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা অর্থ পাচার বন্ধ করার জন্য নানা সময় বলে আসছি। কিন্তু একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, যতদিন অবৈধ অর্থ ব্যবহারের সুযোগ থাকবে ততদিন এই সমস্যা থেকে কোনোভাবেই মুক্তি পাওয়া যাবে না। বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে যারা বিদেশ থেকে অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ তাদের দেশে নিয়ে যাওয়াকে উৎসাহিত করে থাকে। মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে যে কোনো বিদেশি নাগরিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়ে গেলে তাকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। তার অর্থের উৎস সম্পর্ক কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় না। তুরস্ক মালয়েশিয়ার অনুকরণে সেকেন্ড হোম প্রকল্প চালু করেছে। সেখানে এই সুযোগ গ্রহণ করার জন্য অন্তত ২০০ জন বাংলাদেশি আবেদন করেছেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কোনো কোনো নাগরিকের উপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কারো বা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। কিন্তু এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। কারণ বাংলাদেশের মতো অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে ঠিক একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কোনো দেশের একার পক্ষে দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। প্রতিটি দেশ যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং নিজ নিজে দেশে পাচার হয়ে আসা অর্থের ব্যবহার বন্ধ করে তাহলেই কেবল অর্থ পাচার বন্ধ করা সম্ভব। আর অর্থপাচার বন্ধ হলে বিভিন্ন দেশে দুর্নীতি এমনিতেই সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। কেউ পাচার করার উদ্দেশ্যে দুর্নীতি করে না কিন্তু দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ নিজ দেশে ব্যবহারের সুযোগ না থাকার কারণেই মূলত তারা অর্থ পাচার করে থাকে। কেউ যদি জানতো, তিনি অবৈধ উপায়ে যে অর্থ উপার্জন করছেন তা ব্যবহার করতে পারবেন না। ধরা পড়ে গেলে তার অর্থ-সম্পদ সব বাজেয়াপ্ত এবং কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে তাহলে নিশ্চিতভাবেই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রবণতা থেকে সরে আসতেন। অর্থ পাচার রোধে ভুক্তভোগী দেশের (যে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়) চেয়ে পাচারকৃত অর্থ গ্রহীতা দেশের ভূমিকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো দেশ যদি অন্য দেশের নাগরিকের অবৈধ অর্থ-সম্পদ তার দেশে প্রবেশের অনুমতি প্রদান না করে তাহলে কেউই অর্থ পাচার করতে উৎসাহী হবেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি নাগরিকদের অবৈধভাবে পাচারকৃত অর্থ-সম্পদ জব্দ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা যদি সত্যি আন্তরিকভাবে করা হয় তাহলে আগামীতে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

একজন বাংলাদেশি অর্থ-বিত্ত অর্জন করবে এটা খুশির সংবাদ। কিন্তু সেই অর্থ যদি অবৈধভাবে অন্যের হক নষ্ট করে অর্জন করা হয় তাহলে সেটা অত্যন্ত গর্হিত অন্যা কাজ। সরকারিভাবে অর্থ পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। কাউকে দলীয় বিবেচনায় ছাড় দেয়া যাবে না। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা ছিল মূলত দু’টি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোটের মাধ্যমে সরসার গঠন করা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা। এই দু’টি চেতনা এখন কোথায় আছে তা সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারিনি। আর অর্থনৈতিক বৈষম্য কোথায় গেছে তা জানার জন্য গবেষণা করার প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে দেশে হাজার হাজার কোটিপতির সন্ধান পাওয়া যায়। স্থানীয় পর্যায়ের একজন ক্ষুদ্র রাজনীতিবিদও এখন কোটিপতি হয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতি এক সময় ছিল জন সেবামূলক কাজ। এখন তা রীতিমতো ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। দেশে কোটিপতির সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে ভিক্ষুক ও সর্বহারা মানুষের সংখ্যা। টিসিবি’র ট্রাক সেলের পেছনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ক্রমবর্ধমান ভীড় প্রত্যক্ষ করলেই অনুধাবন করা যায় মানুষ কতটা অসহায় হয়ে পেড়েছে পণ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে। স্বাধীনতার পর দেশে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ছিল অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে। এখন তা ভয়াবহ উদ্বেগজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কারো কোনো উদ্বেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেশর বৃহত্তর মানুষকে অভুক্ত বা বঞ্চিত রেখে যে উন্নয়ন করা হয় তা কখনোই প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন হতে পারে না।

https://www.dailysangram.info/post/538301