১৭ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:১২

রেমিট্যান্স কমার সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানিতেও খরা

সাম্প্রতিক সময়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছে। একই সঙ্গে গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশের জনশক্তি রপ্তানিও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দেয়া কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ৫৭৪ জনে নেমে এসেছে, যা গত ৪ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং আগস্টের চেয়ে ২২.৪২ শতাংশ কম। এর আগে গত মে মাসে সবচেয়ে কম ১ লাখ ১ হাজার ৫৫৮ সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল।

মূলত মালয়েশিয়ায় শ্রমিক রপ্তানি তীব্রভাবে হ্রাস পাওয়ায় সার্বিক এই পতনের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। আগস্টে মালয়েশিয়ায় ৪৬ হাজার ১০৫ জন কর্মী গেলেও সেপ্টেম্বরে তা নেমে এসেছে মাত্র ২১ হাজার ৫২০ জনে। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রধান ৪ গন্তব্য সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ওমান এবং কাতারেও জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। তবে সৌদি আরবে এই সংখ্যা বেড়েছে সামান্য।

মালয়েশিয়ায় কর্মী রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে বিএমইটির হস্তক্ষেপকে দায়ী করেছেন শ্রম নিয়োগকারীরা। নতুন কোটা অনুমোদন না হওয়ায় জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার পেছনে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করেন তারা।

চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৯ লাখ ৮৯ হাজার কর্মী বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এরমধ্যে সৌদি আরবে পাড়ি দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি কর্মী, যা মোট সংখ্যার ৩৫ শতাংশ। এরপরে রয়েছে মালয়েশিয়া (২৯ শতাংশ), ওমান (১১ শতাংশ), সংযুক্ত আরব আমিরাত (৮ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (৪ শতাংশ), কুয়েত (৩ শতাংশ) এবং কাতার (৩ শতাংশ)।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশি শ্রমিকদের নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং গৃহপরিচারিকা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই সঙ্গে ড্রাইভার, ইলেকট্রিশিয়ান এবং প্লাম্বার হিসেবেও কিছু সংখ্যক স্বল্পদক্ষ কর্মী নিয়োগ দেয় দেশগুলো। এ ছাড়া ইতালিতে ইতিমধ্যে ১৫,২৪২ জন, যুক্তরাজ্যে ৬,৪৩৪ জন এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪,২১৮ জন কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন। তবে এ সত্ত্বেও বৈশ্বিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে এখনো কম বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিকের উৎস হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।

এদিকে গত কয়েক মাস ধরে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমাগত কমছে। এরমধ্যে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি কমে যাওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেল সেপ্টেম্বরে দেশে মাত্র ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আয় হয়েছে, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম বিরূপভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। সিন্ডিকেটের প্রভাবে নিয়োগ খাতে স্বচ্ছতা নষ্ট হচ্ছে। কয়েকটি সংস্থার কাছে বিএমইটির অগ্রাধিকার থাকায় অনেক সংস্থার জনশক্তি রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া সৌদি আরবের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অসদাচরণের সামপ্রতিক ঘটনায়ও বাংলাদেশি কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়েছেন।

বিএমইটি’র এক কর্মকর্তা জানান, চলতি বছরের শুরু থেকে রেকর্ড সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছে। আমরা সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে তাদের জনশক্তির বার্ষিক চাহিদার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রপ্তানি করেছি। ফলস্বরূপ, সেসব দেশে এখন চাহিদা কিছুটা কম রয়েছে। তবে বছরের শেষ নাগাদ এই চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।

সূত্র জানায়, সাড়ে ৩ বছরের বিরতির পর বাংলাদেশ থেকে আবারো কর্মী নেয়ার জন্য শ্রমবাজার উন্মুক্ত করে মালয়েশিয়া। এ লক্ষ্যে ২০২১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার শ্রম বিভাগ বাংলাদেশ থেকে ৪.৫৭ লাখ নতুন কর্মী নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ কর্মী ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন। অনুমোদন দেয়া বাকি ১.২৭ লাখ কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়া প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, বছরের প্রথম আট মাসে মালয়েশিয়ার বেশির ভাগ কোটা পূরণ হয়ে যাওয়ায় গত মাসে জনশক্তি রপ্তানির সংখ্যা কমেছে। জনশক্তি রপ্তানি কাজের চাহিদার ওপর নির্ভর করে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চাহিদা বাড়লে আমাদের জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি পায়। তবে এই সংখ্যা প্রতি মাসে ওঠানামা করে।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়া দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। ২০২১ সালে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট শ্রম অভিবাসনের ২১.৩৩ শতাংশ, যা ২০২২ সালে ১৭.৭৬ শতাংশে নেমে আসে। যদিও প্রতিবেদন অনুসারে, স্বল্পদক্ষ কর্মীদের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য তেমন পরিবর্তন আসেনি। ২০২২ সালে এ ধরনের শ্রম অভিবাসনের সংখ্যা ছিল ৩.২৬ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৩.২৮ শতাংশ। করোনা মহামারির বিধিনিষেধের কারণে ২০২০ সালে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় সম্পূর্ণ থেমে গেলেও ২০২১ সালের আগস্ট থেকে এই প্রবণতা আবারো ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তখন থেকেই বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। মহামারি শুরুর আগে দেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৬০,০০০-৭০,০০০ কর্মী বিদেশে পাড়ি দিতেন। বাংলাদেশ গত বছর রেকর্ড ১১ লাখ ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশে পাঠিয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=78903