১৭ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:০০

ফিলিস্তিন সংকট ও আমাদের করণীয়

-ড. মো. নূরুল আমিন

আজ থেকে ১০৬ বছর আগে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের শেষের দিকে ১৯১৭ সালের ২রা নবেম্বর বৃটিশ ওয়ার কেবিনেটের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড জেমস বালফোর্ড যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি পত্র তৈরি করেন। পত্রটি ছিল তৎকালীন জায়নিষ্ট লীগের অন্যতম নেতা লর্ড রথচাইল্ডকে উদ্দেশ্য করে লেখা। এতে যুক্তরাজ্যে রাজকীয় সরকারের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের সারাংশ এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, “His majesty’s Government view with favour the establishment in Palestine of a national home for the jewish people and will use their best endeavoers to facilitate the achievement of this object, it being clearly understood that nothing shall be done which may prejudice the civil and religious rights of existing non-jewish communities in Palestin or the rights and political status enjoyed by the jews in any other country.

অর্থাৎ মহামান্য রাজার সরকার ইহুদীদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি জাতীয় বাসভূমি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করছেন এবং এই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তারা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তবে এই বিষয়টি সবাইকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে যে, এর মাধ্যমে এমন কিছু করা হবে না যাতে বর্তমানে ফিলিস্তিনে বসবাসকারী ইহুদী বহির্ভূত কোনও জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের বেসরকারি বা ধর্মীয় অধিকারের কোনও ক্ষতি হয়, অথবা অন্যান্য দেশে বসবাসকারী ইহুদীরা যে অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদা ভোগ করছে তা ক্ষুণ্ন হয়।

গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, এই পত্রে বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহযোগিতা প্রতিশ্রুতি ছাড়াও ইহুদী ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষারও অঙ্গীকার করেছে। তথাপিও দেখা যায় যে, এই পত্রে ‘মুসলিম’ শব্দটি সম্পূর্ণভাবে পরিহার করা হয়েছে।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই গ্যারান্টিটি কার্যকর হয় এবং ইসরাইল একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বৃটেনের এই অঙ্গীকার ফিলিস্তিনের মূল মালিক মুসলমানদের দুর্যোগ বয়ে আনে। আজ ৭০ লক্ষ ফিলিস্তিনী মুসলমান নিজ পিতৃভূমিতে শরণার্থীর মর্যাদা নিয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। লক্ষ লক্ষ মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাবুতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে; জীবন ধারণ ও বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাটুকুও পূরণ করার সুযোগ তারা পাচ্ছে না। তাদের বাড়িঘর, সহায় সম্পত্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইহুদীরা হয় দখল করে নিয়েছে অথবা ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা সকল প্রকার মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। এছাড়াও বর্তমানে লেবাননে প্রায় ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনী শরণার্থী রয়েছেন। আবার সেখানে সিরিয়ার শরণার্থী রয়েছেন। তারা সবাই মিলে এখন লেবাননের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। তুরস্কসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশেও বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনী শরণার্থী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। এ ব্যাপারে থিয়ডর হারজলের একটি প্রসিদ্ধ উক্তি আছে, উক্তিটি বিভ্রান্তিকর। তিনি তার উক্তিতে ফিলিস্তিনবাসীদের স্বীকৃতিই দেন নাই। তার উক্তিটি হচ্ছে, “A land without a people for a people without land.”

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, ইহুদিরা একটি অভিশপ্ত জাতি। তারা আল্লাহর প্রতি কৃত ওয়াদা খেলাপ করে আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূল (আ.)দের হত্যা করেছে এবং দুনিয়াতে ফেতনার সৃষ্টি করেছে। পবিত্র কুরআনে তাদের অপকর্মের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। এই ইহুদিরা ফিলিস্তিনী মুসলমানদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করেই শুধু ক্ষ্যান্ত হয়নি। তারা আমাদের প্রথম কিবলা বাইতুল মোকাদ্দাসও জবরদখল করে মুসলমানদের নামায আদায়ে বাধা দিচ্ছে। একবার তারা আগুন লাগিয়ে এই মসজিদকে ধ্বংস করারও চেষ্টা করেছে। ফিলিস্তিনী মুসলমানদের এখন উদ্বাস্তু ছাড়া আর কোনো পরিচয় নেই। বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন উপস্থাপক ও খ্যাতনামা সাংবাদিক মরহুম ফতেহ লোহানী ফিলিস্তিনীদের দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে একবার যথার্থই বলেছিলেন, ‘একটা পাখি তারও বাসা আছে; সারা দিন এগাছ ওগাছ করলেও রাতে সে তার বাসায় ফিরে যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনীদের কোনো বাসা নেই। এটা মর্মান্তিক। এই গৃহহীন ফিলিস্তিনীরাই হামাস-হিজবুল্লাহর ব্যানারে তাদের জন্মভূমির অধিকার ফিরে পাবার সংগ্রামে লিপ্ত। গত কয়েক বছর ধরে ইসরাইল গাজাসহ অধিকৃত এলাকায় নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন, টার্গেট কিলিং, আল-আকসা মসজিদে অনুপ্রবেশ ও মুসলমানদের নামাযে বাধাদান, বিমান হামলা ও আগুনে বোমা নিক্ষেপ করে নারী-শিশু ও বৃদ্ধসহ হাজার হাজার ফিলিস্তিনীকে হত্যা ও জখমের ন্যায় অমানবিক কার্যাবলী চালিয়ে আসছিল। এতে ধৈর্যচ্যুত হয়ে হামাস যোদ্ধারা দেড় সপ্তাহ আগে আল আকসা ও তাদের বসতি রক্ষার লক্ষ্যে ইসরাইলী টার্গেটে হামলা শুরু করে। এটা তাদের আত্মরক্ষার প্রয়াস ছিল। এরপর ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য গণহত্যার আশ্রয় নিয়েছে। এই গণহত্যা বন্ধ ও ফিলিস্তিনীদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তাদের জন্মভূমিতে তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে বিশ^শক্তিগুলো সক্রিয় কোনো ভূমিকা পালন করছে না। এটা মানবতার অপমান। প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকাও এখানে সন্তোষজনক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। গাজায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণভয়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসি বলেছেন, তিনি কোনো উদ্বাস্তু মিশরে ঢুকতে দেবেন না। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ৭টি দেশ ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য স্¦েচ্ছাসেবক প্রেরণের প্রস্তাব করেছে। ইরান ও তুরস্ক তাদের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছে।

ফিলিস্তিন সমস্যা সারা দুনিয়ার মুসলমানদের সমস্যা। ওআইসি এখানে একটি শক্ত ভূমিকা রাখতে পারতো, কিন্তু রাখছে না। এই সমস্যার মোকাবেলা এবং ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ সংগ্রামকে শক্তিশালীকরণ ও তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য শিয়া, সুন্নি, আরব, অনারব বিভেদ-বিভক্তি ভুলে গিয়ে মুসলিম দুনিয়ার ঐক্যবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। এজন্য আমাদের আলেম-ওলামাদের ঐক্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বুলেটের জবাব বুলেট দিয়ে দিতে হয়, শুধু দোয়া করলে চলে না, সাথে দাওয়াও লাগে। তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অধ্যাপক ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানের একটি প্রসিদ্ধ উক্তি আছে। তিনি বলেছেন, ‘আশি লক্ষ ইহুদির জন্য ২০০ কোটি মুসলমান আবাবিল পাখি আসার অপেক্ষা করছে। আবাবিল যদিও আসে তাহলে তারা মুসলমানদের উপরই পাথর নিক্ষেপ করবে।’ এর কারণ মুসলমানরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না।

যে বোমা (নাপাম বোমাসহ) গাজায় বিস্ফোরিত হচ্ছে তার শেল দামেস্ক, তেহরান, জেদ্দা, ইস্তাম্বুলসহ সারা দুনিয়ার মুসলিম দেশগুলোর ঈমানদীপ্ত প্রতিটি মানুষের কলিজায় আঘাত করছে। পানি, খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ সরবরাহের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করায় যে মা ও শিশুটি মৃত্যুবরণ করছে তাতে আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় এবং চোখে অশ্রু ঝরে।

শুধু ফিলিস্তিন নয় সারা মুসলিম দুনিয়া এখন বৈশ্বিক অবরোধের শিকার। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামগ্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া এই বৈশ্বিক অবরোধ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা।

এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় বহুবিধ। প্রথমত, বাস্তুচ্যুত, বিতাড়িত, আহত ও বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনী মুসলমানদের অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা ও আশ্রয় দানে এগিয়ে আসা এবং তাদের বুঝানো যে, তারা একা ও অসহায় নয়। দ্বিতীয়ত, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইলের প্রতিটি নৃশংসতার বিরুদ্ধে নিন্দাজ্ঞাপন ও বাণিজ্যিকভাবে তাদের বয়কট করা। তৃতীয়ত, আমাদের ঐক্য প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী ও সংহতকরণের মাধ্যমে প্রতিরোধ সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া। নিম্নোক্ত কার্যাবলী এই লক্ষ্যটি সফল করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস :

মুসলিম দেশসমূহের একটি জাতিসংঘ গঠন করা। কাজটি কঠিন ও ব্যয়বহুল। মুসলিম দেশসমূহের যে সম্পদ ও ভোগলিক অবস্থান তাতে তাদের মধ্যে অঙ্গীকারের দৃঢ়তা থাকলে তা মোটেই কঠিন নয়। বর্তমান ওআইসিকে তার কাঠামো ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং কার্যপ্রণালী পুনর্গঠন ও পরিবর্তনের মাধ্যমে মুসলিম জাতিসংঘের রূপ দেয়া যেতে পারে।

মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি সংস্থা গঠন করা দরকার। আটটি মুসলিম দেশের সমন্বয়ে গঠিত ডি-৮ ফোরামকে সম্প্রসারণ করে এই নতুন সংস্থা গঠন করা যায়। মুসলিম দেশগুলো একটি সাধারণ মুদ্রা ব্যবহার করতে পারে বিদ্যমান ডলার, ইউরো ও পাউন্ড, স্টালিং-এর পাশাপাশি এই মুদ্রা মুসলিম দেশগুলোর লেনদেনে কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে তা নির্ণয়ের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যায়। অনুরূপভাবে মুসলিম দেশগুলোর যৌথ প্রতিরক্ষার জন্য একটি সংস্থাও গঠন করা প্রয়োজন।

জার্মান নেতা হিটলারের নির্দেশে ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করা হয়েছিল। বাকীদের তিনি জার্মানী থেকে বহিষ্কার করার সময় বলেছিলেন “এই ইহুদীরা রক্ত-মাংসে একটি অপরাধী জাতি। এদের ছেড়ে দিলাম যাতে দুনিয়ার মানুষ দেখতে পারে এরা কেমন।”

হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া গ্যাবর মেট নামক একজন ইহুদী পণ্ডিত তার স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, “Take the worst thing you can say about Hamas, multiply it by 1000 times and it still will not meet the Israeli repression and killing and dispossession of Palestanians.” অর্থাৎ হামাসের নিকৃষ্ট সব অপরাধগুলোকে একত্রিত করে ১০০০ দিয়ে গুণ করুন তাতে যা হবে তা ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনীদের হত্যা, নির্যাতন ও অধিকারচ্যুতির যে অপরাধ তার কাছাকাছিও হবে না।

আমি ড. নিজামুদ্দিন আরবাকানের একটি উক্তি দিয়ে আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, “Let no one think that Muslims cannot achieve Unity given the current disorder. By the grace of Allah we will definitely establish Islamic Unity, Given the current circumastances of the world, this is not a choice but an obligation.” অর্থাৎ বর্তমান অরাজকতা সত্ত্বেও কেউ যেন চিন্তা না করেন যে, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন না, ইনশাল্লাহ অবশ্যই আমরা এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবো। বিশ্বের বর্তমান অবস্থায় এটা পছন্দের বিষয় নয়, বাধ্যবাধকতার বিষয়।

https://www.dailysangram.info/post/538220