৯ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ৫:৩৮

রাজধানীতে বেপরোয়া ছিনতাইকারীরা

অনিরাপদ হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা। আগে সন্ধ্যায় ও রাতে ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও এখন প্রকাশ্যে এসব অপরাধ ঘটছে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ৩শ’ মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় টানা পার্টির সদস্যরা। মানুষ এখন আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা, একশ্রেণির অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত কিশোর-তরুণদের অপরাধের পথে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আইনশঙ্খলা বাহিনী গত কয়েক বছরে রাজনৈতিকভাবে অধিক ব্যবহৃত হওয়ায় ‘অপরাধ দমনে’ তেমন সাফল্য দেখাতে পারেনি। ক্ষমতাসীনদের বৈধ-অবৈধ আদেশ-নির্দেশে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের যেভাবে জুলুম-নির্যাতনে উৎসাহী তেমন উৎসাহ দেখায়নি অপরাধ নিয়ন্ত্রণে। ফলে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ডিএমপি সূত্র জানায়, রাজধানীর ৫০ থানা এলাকায় ৬১৯৮ জন ডাকাত ও ছিনতাইকারী রয়েছে। এদের মধ্যে ১৭৩৭ জন ছিনতাই এবং ৪৪৬১ জন ডাকাতিতে জড়িত। প্রশ্ন হচ্ছে পুলিশের খাতায় নাম থাকার পরও এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন?
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, সম্পদের অসম বণ্টন, অপরাধ দমনের চেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরোধী দল দমনের প্রবণতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনির অনুপস্থিতি সমাজকে অস্থির করে তুলেছে। এ জিনিসগুলো রাষ্ট্র পরিপূর্ণ করতে পারলেই কেবল পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে।

ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরছিলেন পুলিশ কনস্টেবল মো. মনিরুজ্জামান। ট্রেন থেকে নেমে ঢাকার ফার্মগেটের সেজান পয়েন্টে যেতেই ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। বাধা দিতে গিয়ে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান তিনি। এ ঘটনায় নড়ে চড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তখন যেকোনো মূল্যে ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে অধিনস্থদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদ্য বিদায়ী কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এরপর ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে চলে পুলিশের বিশেষ অভিযান। ধড়াও পড়ে অপরাধীদের একটি অংশ। কিন্তু সময় গড়াতেই পরিস্থিতি সেই আগের মতোই। সাম্প্রতিক সময়ে যেন ছিনতাইকারীরা আরো হিংস্র ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেছে। ছিনতাইকারী নামের দুর্বৃত্তদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অর্থকড়ি হারাচ্ছেন নিয়মিত। কয়েকটি আলোচিত ছিনতাই এবং দুর্বৃত্তদের নিষ্ঠুর হামলায় একাধিক হতাহতের ঘটনায় মানুষের মধ্যে নতুন করে আশঙ্কা ভর করছে।
এদিকে নতুন আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, ছিনতাই কিংবা অপরাধ যারা রুখবে সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যদের কেউ কেউ সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে ছিনতাইয়ে। আরো ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এখন পেশাদার ছিনতাইকারীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে সুন্দরীরাও। বিউটি পার্লার থেকে অপরূপ সাজের সুন্দরীও ধরা পড়েছে ছিনতাইকালে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রভাষক এ বি এম নাজমুস সাকিব ইনকিলাবকে বলেন, আগে ছিনতাই কিংবা অপরাধীর শ্রেণিবিন্যাস ছিল। অথ্যাৎ সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষ এ ধরনের অপরাধ করত। এখন সব শ্রেণির কিশোর বয়সী বিশেষ করে ১৭ থেকে উঠতি যুবকরা ছিনতাইয়ের সঙ্গে যুক্ত। এর অন্যতম কারণ মাদকাসক্তি। মাদকের অর্থের যোগান নিতে এরা ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে। তাদের কাজে বাধা এলে এরা হিংস্র হয়ে ওঠে। যে কাউকে ছুরিকাঘাত করে। গুলি করে। ড্রাগ আসক্তির কারণে যে কোনো ধরনের হিংস্রতার ক্ষেত্রেও তাদের বিবেকবোধ কাজ করে না। এক ধরনের হিরোইজমের মানসিকতা থেকে এই উঠতি তরুণরাই পাড়া মহল্লায় গড়ে তোলে কিশোর গ্যাং কালচার। মাদকাসক্তি থেকে এরা জড়িয়ে পড়ে ছিনতাইয়ের মতো ন্যাক্কারজনক অপকর্মে।

রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় এখন ছিনতাকারীদের দৌরাত্ম্য। বেপরোয়া ছিনতাকারীদেরর ভয়ে পথচারীদের তঠস্থ হয়ে থাকতে হয়। তাদের কবলে পড়ে শুধু টাকা পয়সা নয় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। কেউ কেউ হচ্ছেন আহত। ঢাকা মেডিক্যাল, পঙ্গু, মিটফোর্ড হাসপাতাল সূত্র বলছে, বাস্তবতা হচ্ছে, ছিনতাই হামলার শিকার হয়ে গড়ে প্রতিদিন ৩-৪ জন এসব প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকে ছিনতাইয়ের শিকার হয়েও আসল সত্য এড়িয়ে যান।

সংঘটিত ছিনতাইয়ের সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছেও। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রতিকার মেলে কম। হয়রানির ভয়ে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি করেন না। ফলে ছিনতাইয়ের বেশিরভাগ ঘটনাই থেকে যায় আড়ালে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আয়েষা মাহামুদা ইনকিলাবকে বলেন, নিঃসন্দেহে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধ বেড়েছে। এর কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক থাকার কারণে ক্রাইম বেড়েছে। একটা অপরাধ করে কেউ যখন পার পায় তখন দ্বিতীয় অপরাধ করার সাহস পায়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, গ্রেফতার হলেও উপযুক্ত সাক্ষীর অভাব বা দুর্বল সাক্ষীর কারণে কারাগার থেকে অল্প দিনেই জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। এরপর তারা আবার সক্রিয় হচ্ছে। কেউ কেউ ছিনতাই করে দূর কোনও এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।

ছিনতাই প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজিপি মো. আব্দুল কাইয়ুম ইনকিলাবকে বলেন, সামগ্রিকভাবে হতাশা, বেকারত্ব, ড্রাগ কর্মসংস্থানের অভাব ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে। ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে পুলিশকেই মূল ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনের মধ্যে থেকে তাদের গ্রেফতার, সাজা নিশ্চিতকরণ এবং সংশোধনীর ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারকে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা থেকে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা নিতে হবে। সমাজের জনপ্রতিনিধিদের মহল্লায় মহল্লায় জনসচেতনার জন্য কাজ করতে হবে। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য অপরাধে জড়ানো প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক এ কর্মকর্তা বলেন, পুলিশে রিক্রুটে ভালোভাবে যাচাই এবং ট্রেনিং দিতে হবে। পুলিশের প্রতিটি শাখায় অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা তৎপরতা ও মনিটরিং সেলের তৎপরতা বাড়াতে হবে। আর অবশ্যই দায়ী সদস্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

কেস স্ট্যাডি (এক) : গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাত ২টা। রাজধানীর উত্তরা থেকে ট্রাকে করে ঘরের আসবাবপত্র ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেলেন দুই সহোদর আনোয়ার ও দেলোয়ার। তাদের ট্রাকটি ছেড়ে যাবার মুহূর্তেই উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের বিএনএস সেন্টারের সামনে প্রধান সড়কে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। দুর্বৃত্তচক্র তাদের গতিরোধ করে টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন তারা দুই ভাই ছিনতাইকারীদের ধাওয়া দিয়ে আটকের চেষ্টা করে। আর তখনই ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে দুই ভাইকে চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান দেলোয়ার হোসেন (২৭)। তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন এখনো হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।

কেস স্ট্যাডি (দুই) : গাজীপুরের চান্দনা বউবাজারের বাসিন্দা নূর আলম। পেশায় অটোরিকশাচালক নূর ইসলাম গত বুধবার দিবাগত রাত ১ টার দিকে অটোরিকশা নিয়ে তিনি বের হন। কিছুক্ষণ পরেই চান্দনা সার্ডিরোড এলাকায় ছিনতাইকারী চক্র তার গতিরোধ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্বৃত্তরা তার বুকে ও কানে মাথায় ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। পরে তার লাশ রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়।

কেস স্ট্যাডি (তিন) : গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আসাদগেটে আক্রান্ত হয়ে ছিনতাইকারীদের ধাওয়া করতে গিয়ে গাড়ি চাপায় প্রাণ হারিয়েছেন মানিকগঞ্জ সদরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তাজুল ইসলাম। ঘটনার সময় তিনি একজন কাউন্সিলরের সঙ্গে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারে বসা ছিলেন। ছিনতাইকারী প্রাইভেটকারের খোলা জানালা দিয়ে কাউন্সিলরের মুঠোফোন ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। এ সময় তার ভাগনে তাজুল ইসলাম গাড়ি থেকে নেমে ছিনতাইকারীর পেছনে ছোটেন। পরে একটি গাড়ির চাপায় ঘটনাস্থলেই তিনি প্রাণ হারান। এভাবে প্রতিদিনই ঢাকার কোথাও না কোথাও ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে সর্বশান্তসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নগরবাসী।

অনিয়ন্ত্রিত ছিনতাই প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, সমাজে যখন অর্থনৈতিক অনটন বাড়তে থাকে তখন মানুষ বহুবিধ অসামাজিক কমকা-ে জড়িয়ে পড়ে। মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে। মানুষ তখন যেকোনোভাবে তার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো চেষ্টা করে। আর যেকোনো মূল্যের একটা উদাহরণ হচ্ছে ছিনতাই। নিজের পেটে ক্ষুধা, সন্তানের কান্না কিংবা পরিবারের কারো অসুস্থতায় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কোভিডের পরে বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি। অথচ বাড়েনি কর্মসংস্থান। সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও বর্তমানে কর্মক্ষম মানুষের প্রায় অর্ধেকের মতো বেকার। একদিকে বেকারত্ব অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি। সামাজিক অবকাঠামোগত ভিত তৈরি হয়নি। যতটুকু রাষ্ট্র চেষ্টা করছে তা-ও দুর্নীতির কারণে নষ্ট হচ্ছে। অবকাঠামোগত ব্যবহারগুলো পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একমাত্র বেকারত্ব দূরীকরণ, মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, সম্পদের সুসম বণ্টন এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনির পরিপূর্ণতাই সমাজকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে সক্ষম। এ বাইরে যতই অভিযান চালাক না কেন পুলিশের পক্ষে ছিনতাই নির্মূল করা সম্ভব হবে না।

পুলিশের অপরাধবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে গত দেড় বছরে পাঁচ শতাধিক ছিনতাই, ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত বছর ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ১৬৫টি। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৫৫টি। ডিএমপির তথ্য অনুযায়ী, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে তেজগাঁও, উত্তরা, মিরপুুর, ধানমন্ডি, ওয়ারী ও মতিঝিল এলাকায়।

ছিনতাইয়ের ঘটনায় আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার সময় চিৎকার করেও তারা পুলিশের সহযোগিতা পাননি। এতে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছেন। পুলিশ বলছে, মূলত ভাসমান মানুষ ও মাদকসেবীরা ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশি জড়াচ্ছে।
অপরদিকে মাদকের সহজলভ্যতা, সঙ্গদোষ ও বেকারত্বের হতাশা থেকে মাদক সেবনে জড়িয়ে পড়ছে যুব সমাজ। আর এই কারণে চুরি-ছিনতাই এবং ডাকাতির মতো অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান।

এখন গণপরিবহণের ভেতরেও ছিনতাই হচ্ছে, গত ১০ আগস্ট রাতে টঙ্গীর আউটার সিগনালে কর্ণফুলী ট্রেনে ঢিল ছুঁড়ে ছিনতাই এবং ট্রেনের টিটিকে ছুরিকাঘাত করা হয়। যাত্রীদের অভিযোগ, রেললাইনের আশপাশের ঝোপঝাড় আর বস্তি থেকে বের হয়ে ট্রেনে ঢিল ছুড়ে ছিনতাই করে মাদকসেবী চক্র। বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর রেল পথের বউবাজার, তিস্তার গেট, বনমালা, জয়দেবপুর আউটার সিগন্যালে ঘটছে বেশির ভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা। যাত্রীরা বলছেন, অরক্ষিত স্টেশন, বহিরাগতদের আনাগোনা ও স্টেশনগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অভাবই এমন অপ্রীতিকর ঘটনার কারণ। গত ২২ জানুয়ারি ট্রেনে ছিনতাইয়ে বাধা দিতে গেলে ৩ পুলিশ সদস্যকে ছুরিকাঘাত করে ছিনতাইকারীরা।

পুলিশের কিছু সদস্যও জড়িয়ে পড়েছে ছিনতাইয়ের মতো অপকর্মে। গত ২০ সেপ্টেম্বর অবিশ্বাস্য কায়দায় দিনে দুপুরে আইএফআইসি ব্যাংকের পল্টন শাখায় ঢুকে ২০ লাখ টাকা ছিনতাই করে ডেমরা পুলিশ লাইনে ক্লোজ হয়ে থাকা পুলিশের দুই সদস্য কনস্টেবল মাহাবুব ও কনস্টেবল আসিফ। ঘটনার পর টাকা উদ্ধারসহ অভিযুক্ত দুই কনস্টেবলকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) মতিঝিল বিভাগ।

এর আগে গত বছরের অক্টোবরে রাজধানীর মতিঝিলে ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় তিন পুলিশ কনস্টেবলকে গ্রেফতার করে মতিঝিল থানা পুলিশ। তারা হলেন মো. কামরুল ইসলাম, রাফিজ খান ও তুষার ইমরান।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর মিরপুরে অভিনব কৌশলে ছিনতাইয়ের অভিযোগে মুক্তা বেগম নামে এক নারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। মিরপুর মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, সুন্দরী এই নারী ছিনতাইয়ের আগে তিনি বিউটি পার্লারে গিয়ে সাজেন। পুলিশের খাতায় তিনি তালিকাভুক্ত শীর্ষ নারী ছিনতাইকারী। বিউটি পার্লারের সাজ এবং বেশভূষা দেখে উচ্চবিত্ত মহিলা মনে হওয়ায় সহজেই কেউ সন্দেহ করে না তাকে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছিনতাই করেন তিনি।

ডিএমপির ডিবি প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ জানিয়েছেন, রাজধানীতে গড়ে ৩শ’ মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় টানা পার্টির সদস্যরা। মানুষ এখন আতঙ্ক নিয়ে চলাফেরা করছে।

ডিএমপি সূত্র জানায়, ‘সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেম বা এসআইভিএস’ নামের সফটওয়্যারের তথ্যভা-ারে থাকা তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর ৫০ থানা এলাকায় ছয় হাজার ১৯৮ জন ডাকাত ও ছিনতাইকারী রয়েছে। তাদের মধ্যে এক হাজার ৭৩৭ জন ছিনতাই এবং চার হাজার ৪৬১ জন ডাকাতিতে জড়িত। ওই তথ্যভা-ারে জড়িত ব্যক্তিতদের পূর্ণাঙ্গ বৃত্তান্তও রয়েছে। এদের অনেকে আগেও গ্রেফতার হয়েছিল।

অপরাধ বিজ্ঞানী প্রফেসর খন্দকার ফারজানা রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সমাজে প্রত্যেকের মধ্যে একটা ভোগবাদী মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে। আগে সোসাইটির মধ্যে একটি গার্ডিয়ানশিপ ছিল। এখন সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে গেলে আইনশৃঙ্খলার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাড়ে অপরাধের ঘটনা। তিনি বলেন, ছিনতাইকারীরা ধরাও পড়ছে আবার জেলেও যাচ্ছে। কিন্তু কারাগারে তাদের প্রোপারলি সংশোধন করানো হচ্ছে না। তাই এরা বের হয়ে আবারো ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে।

ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ঢাকা শহরে ভাসমান মাদকসেবীরা এসব করে থাকে। থানা এলাকাগুলোয় নিয়মিত টহল দেয়া হচ্ছে। ছিনতাইয়ের প্রবণতা রাতে এবং ভোরবেলা বেশি দেখা যায় রাস্তা খালি থাকার কারণে। এছাড়া ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রতিরোধে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দারাও কাজ করছে। পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠায় কিন্তু জামিনে এসে একই ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

https://dailyinqilab.com/national/article/608366