৮ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ১০:০৬

তালগোলে খেই হারা নির্বাচন কমিশন

রিন্টু আনোয়ার

কপাল কুণ্ডলার মতো ‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো’- প্রশ্নের মুখে এখন নির্বাচন কমিশন-ইসি। কিছু কাজ ও কথাবার্তায় নিজেদের দিকে প্রশ্নগুলো টেনে এনেছে বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একবার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিতে ইসি কোনো চাপে নেই। কারণ এটি সরকার থেকে সরকার বা জি টু জি বিষয়। নির্বাচন কমিশনের বিষয় নয়। সম্প্রতি আবার বললেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের চাপ পড়েছে বর্তমান কমিশনের ওপর। এর আগে ইসি কথা দিয়েছে, এবার আর রাতে ভোট হবে না; দিনের ভোট দিনেই হবে। হালনাগাদ তাদের নতুন কথা: এক শতাংশ ভোট পড়লেই নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ। প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে এ ধরনের কথা শোনানো দরকার হচ্ছে কেন নির্বাচন কমিশনের?

তবে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কোন হাপলে বা দশায় আছে, তা বুঝতে শেরে বাংলা নগরে নির্বাচন কমিশন অফিসে গিয়ে আড়ি বা কান পাততে হয় না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ তার সহকর্মী কমিশনার ও সচিবের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য খেয়াল করে শোনাই যথেষ্ট। তারা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বার্তা দিচ্ছেন। এতে ভালো রকমের তথ্য জোগান হচ্ছে।

এ পর্যায়ে এসে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি জানালেন, এক শতাংশ ভোট পড়লেই নির্বাচন আইনগতভাবে সঠিক, বৈধ। এটিই যদি খাস কথা বা নিয়মের কথা হয়, তাহলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক- প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা নিয়ে এতো কথা কেন? এক শতাংশ ভোট পড়লেই নির্বাচন বৈধ হয়ে গেলে ভোট করারই বা কী দরকার? এমন অভাবের দিনে ভোটের নামে রাষ্ট্রের এত টাকা নষ্টেরই বা কী দরকার? নাকি তাপে-চাপে খেই হারিয়ে একেক সময় এ ধরনের একেক কথা বেরিয়ে পড়ছে তাদের মুখ ফসকে?

সিইসির এক শতাংশ ভোটের কথাটির আগে-পিছে আরো কিছু কথা ছিল। তিনি বলেছেন, দেশে যদি ১ শতাংশ ভোট পড়ে, ৯৯ শতাংশ না পড়ে লিগ্যালি দ্যাট ইজ রাইট। বৈধতার প্রশ্ন উঠতে পারে। বাট দ্য কোয়েশ্চেন অব লিগ্যালিটি উইল নট অ্যারাইজ। সো দেয়ার ইজ এ কনফ্লিক্ট বিটুইন লিগ্যালিটি অ্যান্ড লেজিটিমেসি। আমরা লেজিটিমেসি নিয়ে মাথা ঘামাবো না। তার কথা কিন্তু পরিষ্কার। এটি নতুন কথাও নয়। তার ২০১৪ বা ১৮ সালের পূর্বসূরি সিইসিরাও লেজিটিমেসি নিয়ে পরোয়া করেননি। অর্থাৎ বিনা ভোটে ১৫৪ জনের এমপি হয়ে যাওয়া বা রাতে ভোট করে ফেলার লেজিটিমেসি নিয়ে প্রশ্ন করা অবান্তর। ওই নির্বাচনগুলোও লিগ্যালি বৈধ। প্রশ্নটা এখন ভিন্ন জায়গায়। সামনে তা হলে কোনো ধরনের লেজিটিমেসিলেস নির্বাচন আসছে? বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে সেই ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সব সরকারের সব নির্বাচনেরই বৈধতা প্রতিষ্ঠিত। সেই বিচেনায় সামনেরটিও বৈধ হতে বাধা কোথায়! এটাও গ্রহণযোগ্যই হবে। আগের রাতে কেন দু-তিন দিন আগে থেকেই বাক্সভর্তি রাখলেও আইনগতভাবে সমস্যা হবে না। ১৫৪ জন কেন প্রায় তিন শ’ আসনে বিনা ভোটে এমপি হয়ে গেলেও সমস্যা হবে না। কারণ যারা এটা পরিচালনা করবেন তারা তো মাত্র এক শতাংশ ভোট পড়লেও নির্বাচন বৈধ হবে বলে জানান দিয়েই দিয়েছেন।

প্রচলিত সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, আগামী ২৯ জানুয়ারি ’২৪ তারিখের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। ক্ষমতাসীনরা যেকোনো মূল্যে এ সময়ের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার বা তুলে আনার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। নির্বাচন কমিশনও তৎপর। বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোটসঙ্গীরা ওই নির্বাচনে না এলেই বা কী? সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের যথাযথ পরিবেশ বিরাজ করছে কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রশ্ন উঠলেই বা কী? ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ইইউসহ বিভিন্ন দেশ নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠালেও কিছু যাবে আসবে না। লেজিটিমেসি নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠবে, কিন্তু এটি আইনত বৈধ হয়ে যাবে। নির্বাচন কমিশন লেজিটিমেসি নিয়ে যে মাথা ঘামাবে না- তা তারা খোলাসা করেই জানিয়ে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত।

দৃশ্যত ইইউর পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি প্রয়োগের ঘোষণার পরও ক্ষমতাসীনরা বরাবরের মতো ড্যামকেয়ার। উপরন্তু বিদেশীদের সাথে তলে তলে সমঝোতা হয়ে গেছে বলে বার্তাও দিচ্ছে। তাদের এই মানসিকতা আত্মঘাতী হয় কি না- এ প্রশ্ন থাকলেও তা গ্রাহ্য না করার একটি মহল তৈরি হয়েছে। তারা মানতেই চাচ্ছেন না, ভোটাধিকার আন্তর্জাতিক আইন ও অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা স্বীকৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের বিষয়, এটি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। তারা এ-ও অনুধাবন করতে নারাজ যে হুট করে যুক্তরাষ্ট্র কারো বিরুদ্ধে ভিসানীতি প্রয়োগ করেনি। দালিলিক তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথ্য-প্রমাণ ছাড়া তাদের কিছু করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ যেসব নির্বাচনী কর্মকর্তা, বিচারক, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা গত নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের অনেকে এবং নতুন দায়িত্বপ্রাপ্তরা এবারও তা করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন এবং অন্যদের তা করার জন্য প্ররোচিত করছেন। কিন্তু আগের প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট যে এক নয় সেটা তারা বুঝেও না বোঝার ভান ধরছেন, অথচ বুঝতে চাচ্ছেন না তাদের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে।

দেশের বৃহত্তর বিরোধী অংশ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে দেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণের এবং যেকোনো উপায়ে একটি একতরফা, বিতর্কিত নির্বাচন প্রতিহত করার যে প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, তা তারা উপলব্ধি করতে পারছেন না, প্রথমবারের মতো নির্বাচনের অনেক আগে ভিসানীতি প্রয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘টেস্ট কেস’। যুক্তরাষ্ট্রের এই নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধাদানকারীদের জন্য একধরনের সতর্কবার্তা। ভোট জালিয়াতি থেকে শুরু করে ভোটের প্রক্রিয়ায় বাধাদানকারী যে কেউ এই নীতির আওতায় পড়তে পারেন। শুধু তা-ই নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কলুষিত করার প্রয়াসে অতীতে যারা লিপ্ত ছিলেন বা ভবিষ্যতেও থাকবেন, তাদের বিরুদ্ধেও এই ভিসানীতি কার্যকর থাকবে। মোটকথা সামনের নির্বাচন এ যাবৎ অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হতে যাচ্ছে। এর ব্যর্থতার দায়দায়িত্ব সর্বপ্রথম নির্বাচন কমিশন ও কর্মকর্তাদের ওপরে বর্তাবে। অতীতে দায়িত্ব না নিয়ে কমিশন পার পেলেও ভবিষ্যতে তা না-ও হতে পারে। লিগ্যালিটি এবং লেজিটিমেসির জ্ঞান এবার কাজে না-ও লাগতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে ব্যাপক চাপ রয়েছে। ভৌগোলিক, ভূ-রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, রাশিয়া, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশেরই চোখ বাংলাদেশের ২৪ সালের নির্বাচনের দিকে। সেখানে যোগ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি। আফ্রিকার কয়েকটি দেশে এ ধরনের ভিসানীতি কার্যকর করা হয় নির্বাচনের পর। ফলে এই নীতি তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই।

নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। সেখানেই এখন দুঃখজনক খেই হারানো ভাব। তাও প্রকাশ্যে। তার ওপর তাদের কিছু ক্ষমতা নির্বাচনের ঢের আগেই কতল করে নেয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদে আরপিও সংশোধনী আইন পাসের মাধ্যমে পরাধীন ইসিকে আরো পরাধীন করার কাজটি সাঙ্গ করেছে বর্তমান সরকার। নির্বাচন কমিশন এতে আপত্তি করেনি, শরমও পায়নি। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ (এ) উপধারায় ছিল, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সঙ্গত ও আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, ভোট গ্রহণের আগে ইসি চাইলেও এখন আর নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা করার পর কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও পুরো আসনের ফলাফল স্থগিত বা ভোট বাতিল করতে পারবে না ইসি; শুধু যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ থাকবে, সেসব কেন্দ্রের ফলাফল চাইলে স্থগিত করতে পারবে। এই অক্ষমতার জেরে কমিশনের এখন একেক সময় একেক কথা বলা ছাড়া গতি নেই। আবার খেই হারানোর কথা স্বীকারের জোও নেই। বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের চাপ তাদের মালুম হচ্ছে। কিন্তু তামাদি চাপের সাথে সামনে যে আরো চাপ-তাপসহ কত কী অপেক্ষা করছে তা বোঝার পর্বে যাচ্ছে না কমিশন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/782510