৮ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ১০:০৪

এ দেশের সৌভাগ্য হচ্ছে জনগণ’

সালাহউদ্দিন বাবর

পশ্চিমের এক প্রাজ্ঞ সাংবাদিক বেশ কিছুকাল আগে ক’দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, তাইওয়ান ও সিঙ্গাপুর ঘুরে ঢাকায় আসেন। ঢাকার আরেক প্রবীণ সাংবাদিক তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই ক’দিনে বাংলাদেশ সম্পর্কে তোমার ইমপ্রেশন কী? জবাবে সেই পশ্চিমা সাংবাদিক বলেছিলেন, আমার ইমপ্রেশন সম্পর্কে যদি জানতে চাও, তবে আমি এ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা বক্তৃতা করতে পারব। যদিও এখানে আমি মাত্র কয়েক দিন ধরে অবস্থান করছি। তবে এত সময় আমার হাতে নেই। তোমারও কয়েক ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা শোনার সময়ও নেই বলে বিশ্বাস করি। সে ক্ষেত্রে আমি মাত্র কয়েকটি বাক্যে আমার অভিজ্ঞতা তোমার সাথে শেয়ার করতে পারি। তোমাদের এই দেশের পরম সৌভাগ্য হচ্ছে এ দেশের মানুষ। তারা অতিথিপরায়ণ, বিদেশীদের ভালোবাসে, অত্যন্ত ধৈর্যশীল, পরিশ্রমপ্রিয় ও অল্পে তুষ্ট। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তারা নীরব ও ধীরস্থির থাকে। আর বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যের কারণ তোমাদের প্রশাসন। তারা নিজেদের যতটা ভালোবাসে, তাদের প্রাপ্যতা নিয়ে যতটা সক্রিয়, ঠিক ততটাই উদাসীন নাগরিকদের অধিকার নিয়ে। নাগরিকদের সাচ্ছন্দ্য বিধান ও প্রাপ্ততা নিয়ে। তোমাদের সরকার ও প্রশাসন একেবারেই নির্লিপ্ত উদাসীন এসব বিষয় নিয়ে।

মাত্র কয়েকটি বাক্যে সেই সাংবাদিকের অন্তর্দৃষ্টি কতটা প্রখর তা পরিষ্কার হয়। মাত্র কয়েক দিনেই তিনি বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একেবারে হালের পরিস্থিতির কথা ভাবুন এবং সেই সাংবাদিকের মূল্যায়নের বিষয় স্মরণ করুন। সবাই লক্ষ করেছেন, মাত্র ক’দিন আগে, সারা দেশে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি সব জলমগ্ন হয়ে গিয়েছিল। হরহামেশা এমনই হয়ে থাকে। সে কারণে হাজারো মানুষ বারবার চরম দুর্ভোগে পড়েন। এসব মানুষের বহু কোটি টাকার সম্পদ এভাবে বিনষ্ট হয়। কখনো কি কেউ তাদের খোঁজখবর নিয়েছেন? বস্তুত বারবার এমন জলাবদ্ধতা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ব্যর্থতার নজির। এত কষ্টের পরও মানুষ পাথর হয়েছিল।

আরো কথা আছে। এই তো সম্প্রতি তেজগাঁওয়ে ভুবন শীলের পরিবারের সব স্বপ্ন ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেল। সমাজের কতগুলো নিকৃষ্ট কীটতুল্য সন্ত্রাসীর গুলিতে ভুবন শীলকে এ ভুবন ছেড়ে চলে যেতে হলো। এই কীটদের কারা দানাপানির জোগান দিয়ে দুর্ধর্ষ করে তুলেছে সেটি সবাই জানে। অথচ ভুবন শীলের পরিবারে পাশে দাঁড়াতে কাউকেই দেখা যায়নি। যারা ভুবন শীলের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়নি, সেই কর্তৃপক্ষই ঢাকাসহ গোটা দেশ ডুবে যাওয়ায় নীরব-নিষ্ক্রিয় ছিল। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্যই তারা কারো দিকে তাকানোর অবকাশ পায়নি।

অথচ তারা কিন্তু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। এখন ডেঙ্গুজ্বরে শিশুসহ দেশের দুই লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত। এই জ্বরে হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা ছিল, ডেঙ্গুর চিকিৎসাসামগ্রীর দু®প্র্রাপ্যতার পেছনে নাকি ছিল বহুল আলোচিত সেই সিন্ডিকেট। জাতিসঙ্ঘ এই দুর্যোগকে মহামারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। শোনা যায়, সরকার তাতে নাকি সাড়া দেয়নি এই ভয়ে যে, মহামারী বললে তাদের দায়িত্ব অনেক গুণ বেড়ে যাবে। এই জ্বরে বহু মা তার সন্তান হারিয়েছেন, অনেক স্ত্রী স্বামী হারিয়েছেন। তেমনি স্বামী হারিয়েছেন তাদের জীবনসঙ্গিনীদের। স্বজন হারানোর কষ্ট যে কত তা সেই বেশি অনুভব করতে পারেন যিনি হারিয়েছেন স্বজনদের। তারা বুকে পাষাণ বেঁধে এখনো নীরব। এ থেকে প্রমাণিত, দেশের মানুষ কতটা সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল; আর প্রশাসন কতটা নির্লিপ্ত উদাসীন।

সেই বিদেশী সাংবাদিক বলেছিলেন, এ দেশের সরকার নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। হালের অবস্থাটা যদি বিবেচনায় নেয়া যায়, তবে এটা দেশবাসীর কাছে একেবারেই স্ফটিক স্বচ্ছ হবে। সেই কর্তৃপক্ষ এখন নিজেদের স্বার্থ হাসিল নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে কোনো দিকে তাকানোর একটি মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের হাতে নেই। সরকার ও তাদের অনুগত ‘রাষ্ট্রীয় প্রশাসন’ সবাই একাকার হয়ে আছে তাদের অভিন্ন ভাবনা নিয়ে, নিজেদের ‘স্যালভেশন প্রোগ্রামে’ ব্যস্ত। আরো কত শত সমস্যা-সঙ্কট দেশে সৃষ্টি হয়ে রয়েছে এবং হচ্ছে, সেদিকে কারো কোনো নজর নেই; এমন নির্লিপ্ত প্রশাসনের যারা এখন পুনর্’াপন চান। বিদ্যমান প্রশাসন থেকে তাদের হুঁশিয়ার করা হচ্ছে এই বলে যে, তাদের হাত-পা ভেঙে দেয়া হবে। তাদের ভাষা এবং ধারণা এমনই উগ্র সহিংস। তাদের রাজনৈতিক স্বার্থের এতটুকু অন্তরায় যারা হবে, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলা হবে।

সারা দেশে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি বাদলের কথা বলা হয়েছে। এমন প্রবল বৃষ্টির হেতু কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে জড়িত। সবার জানা জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে যেসব দেশ উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, সে তালিকার শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। এখানেও সেই এক কথা, কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে তেমন গা করছে না। এখানেও সেই হেলা আর উদাসীনতা। বিশ্ব ফোরামে এ নিয়ে বাংলাদেশ উচ্চকণ্ঠ আর ঘরে নিতান্ত রুটিন কাজটাও করছে না।

আজ থেকে ৫২ বছর আগে যখন এ দেশে সংবিধান রচিত হয়েছিল, তখন সেখানে পরিবেশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা ছিল। যেমন বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য জলাভূমি বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ সংবিধানের অন্যান্য বহু দিকনির্দেশনা নিয়ে যেমন হেলাফেলা করা হয়, উদাসীনতার শেষ সীমা অবলীলাক্রমে অতিক্রম করা হয়- ঠিক পরিবেশ নিয়ে দেশে হেলাফেলা আর উদাসীনতা কিছুমাত্র কম নয় বরং অনেক বেশি। অথচ এখন যে জায়গায় এসে দেশ পৌঁছেছে, সেটিকে বলা যায়, জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণ। প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী কয়েক দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে কোথাও কোথাও ১৪ থেকে ৩৩ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় পৌঁছবে। এদিকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৯ দশমিক ৫৩ ফুট। আর রাজধানী ঢাকার গড় উচ্চতা মাত্র ১৩ দশমিক ১২ ফুট। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এই শতকে কয়েক দশকের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৪ ফিট বাড়বে, তাতে দেশের কোটি মানুষের আবাসস্থল এই শহর পানির নিচে তলিয়ে যাবে। ঢাকা ছাড়াও তলিয়ে যাবে বন্দরনগরী চট্টগ্রামও। সেখানে শাহ আমানত বিমানবন্দর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ দশমিক ১২ ফুট উঁচুতে। এসব তথ্য থেকে বোঝা যায় দেশ কোথায় এখন আছে।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঠিকই বুঝেছিলেন, দেশ জলবায়ুর ভয়াবহ হুমকির মুখে রয়েছে। সে বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন গত শতাব্দীর আশির দশকে। তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে হাজার হাজার খাল-বিল-নদী-নালী, হাওর-বাঁওড়, হাজামজা জলাশয় পুনঃখনন শুরু করেছিলেন হুমকি মোকাবেলার প্রাথমিক কর্মসূচি হিসেবে। এসব খননের কাজে তিনি স্বয়ং উপস্থিত থেকে অংশ নিতেন। সড়ক-মহাসড়কের দু’ধারে হাজার বৃক্ষরোপণ শুরু করেছিলেন। শুধু বৃক্ষরোপণ নয়, তা দেখভালের জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সে সময় খাল কাটা নিয়ে এক মহাজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল দেশে।

কথায় আছে, ‘উল্টা বুঝিলি রাম’। জিয়ার খাল কাটা নিয়ে তেমনি উল্টো প্রচারে নেমেছিল আওয়ামী লীগ। ঠিক উল্টা বোঝা হয়তো নয়। নিছক হিংসা-বিদ্বেষ থেকে তারা বলেছিল, জিয়া খাল কেটে কুমির আনছে। এমন খালকাটা কতটা ভালো বা মন্দ ছিল তা সরেজমিনে দেখার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮০ সালে, যখন আমি একটি জাতীয় দৈনিকের জুনিয়র রিপোর্টার। সারা দেশ থেকে ত্রিশের বেশি সাংবাদিককে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে কক্সবাজার নিয়ে গিয়েছিলেন। কক্সবাজার শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চৌদ্দ কিলোমিটার দীর্ঘ খননকৃত উথলী খাল দেখানোর জন্য। মাইক্রোবাসে আমরা সবাই উথলী খালের পাশে এসে জমায়েত হয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর রাষ্ট্রপতি আমাদের সাথে মিলিত হলেন। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত একটা বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন, সমালোচনা হয় আমি নাকি খাল কেটে কুমির আনছি। আপনারা দেখুন এই উথলী খালে কটা কুমির এসেছে, না অন্য কিছু হয়েছে। স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলুন। সব জানতে চেষ্টা করুন। আমরা শুনলাম উথলী খাল প্রায় ভরাট হয়ে গিয়েছিল। সেখানে ব্যাঙ আর বাঙাচির বাস ছিল। খাল পুনঃখননের পর খালে তখন পানি টইটম্বু^র হয়ে আছে। খালে মাছচাষ হচ্ছে। খালের পানি নিয়ে সেচ দিয়ে দু’বার ধান চাষ হচ্ছে। এখান থেকে পানি নিয়ে তৃতীয় ফসল হিসেবে শত শত সবজির বাগানে সবজি ফলানো হচ্ছে। খালের দুই তীরে অসংখ্য ফলদ বৃক্ষ রোপিত হয়েছে। চতুর দিকে সবুজের এক অপূর্ব সমারোহ। উল্লেখ্য, এই খাল স্বেচ্ছাশ্রমে পুনঃখনন করা হয়েছিল।

আমরা জানি, বায়ুর মান বৃদ্ধির জন্য প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে কোটি কোটি টাকা খরচে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ পালিত হয় বহু দিন থেকে। এজন্য বহু টাকা খরচ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কেউ জানেন না এত বৃক্ষরোপণের পর তার কতগুলো বাঁচে গরু ছাগলের হাত থেকে। বায়ুর মান বৃদ্ধি করাও বৃক্ষরোপণের একটা উদ্দেশ্য হয়তো ছিল। তবে দেশে বায়ুর মান তাতে এতটুকু বাড়েনি বরং বায়ুদূষণ এতটা বৃদ্ধি পেয়েছে যে, বায়ুর দূষণজনিত কারণে দেশবাসীর গড় আয়ু পৌনে সাত বছর কমেছে। এক গবেষণা নিবন্ধ থেকে দূষণ সম্পর্কিত এই সব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। অতি সম্প্রতি সে গবেষণার পরিপত্র প্রকাশিত হয়েছে। সরকার বলে বেড়ায় দেশে প্রভূত উন্নতি হয়েছে। তবে কেন বায়ুর মান বৃদ্ধি করতে সরকার এমন ব্যর্থ হলো- এর কোনো জবাব কেউ এ পর্যন্ত পায়নি। গড় আয়ু কেন কমল।

অথচ রাষ্ট্রের মালিক মোক্তার জনগণ। এদের শতভাগ অধিকার রয়েছে সমাজ-রাষ্ট্রের সব তথ্যাদি অবহিত থাকার। জনগণকে অবহিতকরণের বিষয়টি সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক প্রশাসনের প্রাথমিক শর্ত, কিন্তু এই প্রাথমিক শর্তটা এখনো প্রশাসন নিশ্চিত করতে পারেনি। কোনো কাজের সূচনায়ই যদি গলদ থাকে, তবে কোনোভাবেই কোনো কাজ সুসম্পন্ন হতে পারে না। জনগণকে দ্রুত বিষয়টি বুঝতে হবে। এর প্রতিবিধানে বিলম্ব করার কোনো অবকাশ নেই। জনমনে আরো প্রশ্ন রয়েছে। তাদের জীবন থেকে যে সাত বছর হারিয়ে গেল সেটা ফেরত দেবে কে?
ndigantababar@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/782512