৮ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ১০:০৩

বিএনপি এবং আ. লীগের মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ : সামনে সম্মুখ সমর

আসিফ আরসালান

সত্য কথা বলতে কী, আওয়ামী লীগের নেতারা বিশেষ করে জেনারেল সেক্রেটারি এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কখন কোথায় কী বলেন আর কী জন্য বলেন, সে ব্যাপারে আমি সত্যি কনফিউজড হয়ে যাই। অনেক দিন ধরেই ওবায়দুল কাদের একটি কথা বলে আসছেন। সেটি হলো, ‘খেলা হবে’। বলাবাহুল্য, এই কথাটিও তিনি ধার করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের নিকট থেকে। ঐ খেলা আর এই খেলা এক খেলা নয়। একবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর সেলফি নিয়ে কথা বললেন। সেটা তিনি বলেছিলেন সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসার জন্য গমনের আগেই। ৭ দিন পর তিনি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসেছেন। এসেই আবার সেই সেলফির কথার পুনরাবৃত্তি করেন। এবার তিনি এমন একটি কথা বলেন যেটি মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র চাঞ্চল্যই সৃষ্টি করেনি, রীতিমত চমকে দিয়েছে। চমকে দিয়েছে বললে ভুল হবে। বরং বলা যায় তার এবারের উক্তি শুনে সাধারণভাবে শিক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তিরা বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। ক্ষমতার রাজনীতিতে এবং কূটনীতিতে প্রকাশ্যে এবং পর্দার আড়ালে অনেক কিছুই ঘটে। প্রকাশ্যে যা ঘটে সেটি তো মানুষ দেখতেই পান। কিন্তু পর্দার আড়ালে যা ঘটে সেটি প্রকাশ করার জন্য নয়। সেটি বরং পর্দার আড়ালেই থেকে যায়। মানুষ বরং তার ফল আউট দেখে কিছু দিন পরে। সেটি ভালও হতে পারে, খারাপও হতে পারে।

এবার ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন, “দুই সেলফিতেই সব ফয়সালা হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, তলে তলে আপোষ হয়েছে।” কার সাথে কার আপোষ হয়েছে সেটি তিনি পরিষ্কার করেননি। তারপর বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের তলে তলে আপোষ হয়েছে। আমাদের ভয়ের কিছু নাই। ভারত আমাদের সাথে আছে, আমরাও ভারতের সাথে আছি।”

প্রথমে সেলফির কথায় আসি। গত মাসে সম্ভবত ১০/১২ তারিখে দিল্লীতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী দিবসের রাতে হোস্ট কান্ট্রি হিসেবে ভারত নৈশ ভোজের আয়োজন করে। বাংলাদেশ জি-২০ এর সদস্য না হলেও ঐ সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নরেন্দ্র মোদির বিশেষ দাওয়াতে শেখ হাসিনা তার কন্যা পুতুলসহ ঐ সম্মেলনে যোগ দেন। তারা স্বাভাবিকভাবেই নৈশভোজে অংশ নেন। এই নৈশ ভোজেরই এক ফাঁকে শেখ হাসিনা, পুতুল এবং জো বাইডেন সেলফির ফ্রেমে বন্দী হন। এ ব্যাপারে ৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে ৩ কলামব্যাপী শিরোনাম দিয়ে একটি খবর প্রকাশ করা হয়েছে। খবরের শিরোনাম, “দিল্লীতে সেলফি তোলার ফাঁকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা বলেছেন বাইডেন”। আরেকটি ছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের যোগদান। সেখানেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ ভুক্ত প্রায় ১৮০ টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সম্মানার্থে এক নৈশ ভোজের আয়োজন করে। ঐ নৈশ ভোজেও শেখ হাসিনা জো বাইডেনের সাথে সেলফি তোলেন। এই দুটি সেলফির কথা বলতে গিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, দুই সেলফিতেই সব ফয়সালা হয়ে গেছে। এই বিষয়টি অনেক পুরাতন। এ সম্পর্কে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়ে গেছে। তাই বিষয়টি আর নতুন করে বলতে হবে সেটি ভাবিনি। অতীতেও আমরা যেমন বলেছি, তেমনি আজও বলছি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে শেখ হাসিনার কোনো রকম আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। এসব ভিভিআইপির সাথে শত শত লোকের সেলফি তোলা আছে। একটি দুটি সেলফি তুললেই একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, এমন কথা কোনো দিন শুনিনি। সুতরাং ওবায়দুল কাদের যখন এই রকম একটি বালখিল্য কথা বলেন তখন মানুষ সেটিকে হেসে উড়িয়ে দেন। এছাড়া তাদের করার আর কিছু থাকে না।

॥ দুই ॥
সেলফি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে কোনো সিরিয়াস কথা হয়েছে তেমন কথা এতদিন পর্যন্ত অন্যরা তো দূরের কথা, শেখ হাসিনাও প্রকাশ করেননি। এই কথাটি এতদিন পর গত ৪ অক্টোবর মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ বিষয়ক সমন্বয়কারী জন কিরবি প্রকাশ করলেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে জি-২০ সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রায় ২০ দিন পর এমন কথা সামনে এলো কিভাবে? যেখানে একটি সেলফি নিয়ে দেশে ও বিদেশে সেটি প্রচারের জন্য বাংলাদেশ সরকার রীতিমত ক্যাম্পেইন করে সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনাকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলেছেন, সেটি ২০ দিন পর এভাবে প্রকাশিত হলো কেন?

ঐ একই সংবাদ ব্রিফিংয়ে জন কিরবি আরো জানান যে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। এই সাক্ষাৎকারটি চলে ১ ঘন্টা ধরে। এই বৈঠকেও নাকি জ্যাক সুলিভান অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ওপর জোর দেন। এখানেও একটি প্রশ্ন এসে যায়। জ্যাক সুলিভান এবং শেখ হাসিনার মধ্যে অনুষ্ঠিত এই সৌজন্য বৈঠকের খবর ৮ দিন পর প্রকাশ পেল কেন? কোন্ পটভূমিতে এই দুইজনের সাক্ষাৎ হয়েছে? সেটিও ইন্টারেস্টিং। প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ দূতাবাস পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। যখন তিনি দূতাবাস পরিদর্শন করছিলেন তখন কোনো এক ফাঁকে জ্যাক সুলিভান সেখানে হাজির হন এবং তারপর দুজনের বৈঠক হয়। এই খবরটিও ৭ দিন চাপা ছিল কেন? সেটি অনেকের মনে এখন প্রশ্ন।

বাংলাদেশের এখন আর কোনো সমস্যা নাই। সকলের সাথেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। এমন একটি কথা ঘোষণা করে ওবায়দুল কাদের উল্লাস প্রকাশ করেছেন। আর তলে তলে ফয়সালা হয়েছে, এই কথা বলে ওবায়দুল কাদের আরো বেশি উল্লসিত হয়েছেন। এই ব্যাপারে গত ৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার ইংরেজি ডেইলি স্টারের প্রধান সম্পাদকীয়তে এ ব্যাপারে কতগুলো গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। ডেইলি স্টার জানতে চেয়েছে, জনগণ জানতে চায়, পর্দার অন্তরালে আসলে কী ফয়সালা হয়েছে? এই ফয়সালার মাধ্যমে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে? এই তথাকথিত ফয়সালার বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেয়েছে? এই ফয়সালার অন্তর্নিহিত অর্থ কি এই দাঁড়ায় যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে যারা বাধা দেবে তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে? এই ফয়সালার অর্থ কি এই যে, ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সরকারকে আর চিন্তা করতে হবে না? আরো একটি প্রশ্ন এসে যায়। নির্বাচনের আগে তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। এই পূর্বশর্তও কি আর প্রযোজ্য নয়? ভোট গণনা এবং তার ফলাফল ঘোষণা নিয়েও গত দুইটি নির্বাচন দারুণভাবে বিতর্কিত হয়েছে। এখন কি এই ভোট গণনা এবং ফলাফল ঘোষণা- এগুলো আর কোনো বিবেচ্য বিষয় হবে না?

॥ তিন ॥
তলে তলে সব ফয়সালা হয়ে গেছে। ভারত আমাদের পাশে আছে, আর আমরাও ভারতের পাশে আছি। আমেরিকার প্রয়োজন ভারতকে। এর পরে তিনি আর কিছু বলেননি। কিন্তু এসব কথার উপসংহার কী দাঁড়ায়? আমেরিকার প্রয়োজন ভারতকে। তাই আমেরিকা ভারতের কথা ফেলতে পারে না। ভারত বাংলাদেশে শেখ হাসিনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে আমেরিকাকে। আর আমেরিকা বাংলাদেশের ব্যাপারে অগ্রসর হয়নি। তাই যদি হবে তাহলে শেখ হাসিনাও তো জি-২০ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে দেড় ঘন্টা বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে ২০ মিনিট ছিল দুই প্রধানমন্ত্রীর একান্ত বৈঠক। কই, ২০ দিন হয়ে গেল, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে কথা হয়েছে তেমন কথা তো একবারও বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বলা হয়নি। সেই বৈঠকের পর ১০ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ১০ দিন পর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। আমেরিকার সাথে যদি ভারতের মাধ্যমে সবকিছু তলে তলে ফয়সালা হয়েই থাকে তাহলে হাসিনা-মোদি বৈঠকের ১২/১৪ দিন পর ভিসা নিষেধাজ্ঞা এলো কেন?

॥ চার ॥
এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নাই। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরেও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন যে নিষেধাজ্ঞার পরিধি ব্যাপক। যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তারা ছাড়াও অন্য যে কোনো ব্যক্তি যদি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা দান করেন তাহলে তিনিও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবেন। ৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বিষয়টি আরো খোলামেলা করেছেন। তিনি বলেছেন যে অন্যেরা তো আছেই, এমনকি কোনো গণমাধ্যম যদি সঠিক, নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ খবর ও মন্তব্য প্রকাশ না করে, যদি তারা তাদের পলিসির দোহাই দিয়ে এমন সব খবর ও ভাষ্য প্রকাশ করে যা সঠিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে সেই সব গণমাধ্যমও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে।
ঐদিকে লন্ডনে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের এক সমাবেশে বলেছেন যে আমেরিকার ভিসা নীতিকে তিনি পারোয়া করেন না। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরকেও তিনি ভিসানীতি পরোয়া না করার পরামর্শ দেন। তাহলে তলে তলে কী ফয়সালা হলো? এটিই এখন সর্বমহলে জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ওবায়দুল কাদের এবং আওয়ামী লীগের সর্বময় নেতা শেখ হাসিনার কথার মধ্যে আপাত কোনো মিল নাই। শেখ হাসিনা মার্কিন ভিসা স্যাংশনকে পরোয়া না করার আহ্বান জানিয়েছেন তার নেতাকর্মীর মনোবল চাঙ্গা করার জন্য। আর অন্যদিকে তলে তলে ফয়সালা হয়েছে সে কথাও ওবায়দুল কাদের বলেছেন কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করার জন্য। কিন্তু তাদের কথা এবং কাজের মধ্যে প্রবাদ বাক্যের মতো একটি ফাঁক রয়েছে। আর সেই প্রবাদ বাক্যটি হলো, There is always a gap between the cups and the lips, অর্থাৎ চায়ের কাপটি মুখে নেয়ার সময় চায়ের কাপ এবং ঠোঁটের মধ্যে সব সময় একটি ফাঁক থেকে যায়। তাই ওবায়দুল কাদের তলে তলে ফয়সালা এবং বাস্তবতার মধ্যে, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মতে, একটি শুভংকরের ফাঁক রয়েছে।

আরো অনেক কথা রয়েছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া। এটি একটি বিশাল দেশ। যে কারণে অনেক ভূগোল বিশারদ এটিকে একটি আলাদা মহাদেশ বলে মনে করেন। দেশটি বড় হলেও অত্যন্ত শান্তশিষ্ট। এতদিন তারা বিশ্ব রাজনীতির সাত পাঁচে ছিলেন না। এবার সেই শান্তশিষ্ট অষ্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের ১৫ জন সদস্য বাংলাদেশের নির্বাচনে বিঘœ সৃষ্টিকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ওপর সেই ধরনের স্যাংশন আরোপের জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নিকট সুপারিশ করেছেন, যে ধরনের স্যাংশন আরোপ করা হয়েছে র‌্যাবের ওপর। ঠিকই তারা ম্যাগনডস্কি নিষেধাজ্ঞা বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই ধরনের আরো অনেক বিষয় আছে যেগুলো আগামী সপ্তাহের কলামগুলোতে উঠে আসবে।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://www.dailysangram.info/post/537400