৮ অক্টোবর ২০২৩, রবিবার, ১০:০২

রিজার্ভ বিপর্যয় অব্যাহত

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এমনকি সার্বিক পরিস্থিতি এখন একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে এসেছে ঠেকেছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখা গেলেও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন দেশের আত্মসচেতন মানুষ। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২৬ দিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছিল ১৯১ কোটি ৪৮ লাখ মার্কিন ডলার। তার পরের এক সপ্তাহে আরও কমেছে ৯ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে প্রায় এক মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২০০ কোটি বা ২ বিলিয়ন ডলার। যা রীতিমত উদ্বেগজনক বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে রিজার্ভের এই চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৩১ আগস্ট রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩০৬ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। গত বুধবার শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। যার অর্থ হচ্ছে, ৩৪ দিনের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ২০১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি (২৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন) ডলার। অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ১০৫ কোটি ডলার। এর বাইরেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেওয়া হয়। সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন প্রায় ১ হাজার ৭০০ কোটি বা ১৭ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছরে প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি ডলার করে কমেছে।

গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ভোগ্যপণ্য, জ্বালানি তেল ও পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। যদিও ওই অর্থবছর শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের পদক্ষেপ নেয়। বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিছু পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম ধরে রাখে। পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে ব্যাংকগুলোর হাতে ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এখন যে প্রকৃত রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে শুধু তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানো যাবে বলে জানা গেছে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। সেই হিসাবে বাংলাদেশ এখন শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছে। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচকই হলো বৈদেশিক মুদ্রার এই রিজার্ভ। বাংলাদেশকে দেওয়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত ছিল গত জুনে প্রকৃত রিজার্ভ ২ হাজার ৪৪৬ কোটি ডলার, গত সেপ্টেম্বরে ২ হাজার ৫৩০ ডলার এবং ডিসেম্বরে ২ হাজার ৬৮০ ডলারে রাখতে হবে। এ জন্য লিখিতভাবে বাংলাদেশকে প্রকৃত রিজার্ভের হিসাবায়ন পদ্ধতি জানিয়ে দেয় আইএমএফ। এই হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য আইএমএফকে জানানো শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভ রাখতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

অর্থনীতিবিদরাও দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, দেশে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ঢুকছে এবং যা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার প্রকৃত হিসাব মিলছে না। লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি তৈরি হওয়ায় রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। এখন যে রিজার্ভ আছে, তা বিপজ্জনক পর্যায়ে না গেলেও উদ্বেগজনক পর্যায়ে। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন ডলার কমছে। এই অবস্থায় চললে একসময় ফুরিয়ে যাবে। তখন ডলারের দাম বাজারে ছেড়ে দিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো উপায় থাকবে না।

সার্বিক দিক বিবেচনায় আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ পরিস্থিতি এখন রীতিমত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমতাবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ব্যাপকভিত্তিক কৃচ্ছ্র সাধনের কোন বিকল্প নেই। জোর দিতে হবে রেমিট্যান্স আহরণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধির দিকে। একই সাথে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটেরও শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া দরকার। অন্যথায় আগামী দিনে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেবে।

https://www.dailysangram.info/post/537399