৭ অক্টোবর ২০২৩, শনিবার, ১২:৫০

বৃষ্টি বন্যায় বিপর্যস্ত সারাদেশ

বগুড়ার শেরপুরে ২ হাজার পরিবার পানিবন্দি

টানাবৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট বন্যায় সারাদেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জনজীবন হয়ে পড়েছে স্থবির। অতিবৃষ্টির কারণে দেশের মহানগরগুলোতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা বৃষ্টির পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ায় বিপাকে পড়েছেন খেটেখাওয়া মানুষ। বিশেষ করে ভোগান্তিতে পড়েছে রাজধানীর দিনমজুর ও নি¤œ আয়ের মানুষ। আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েও বের হতে দেখা যায় কাজের সন্ধানে।

টানাবৃষ্টিতে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষও ভোগান্তিতে পড়েছেন। অনেকেই জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়ার পর গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পোহাতে হয়েছে ব্যাপক বিড়ম্বনা। কেউ ছাতা নিয়ে পায়ে হেঁটে, কেউবা বৃষ্টিতে ভিজেই পৌঁছেছেন গন্তব্যস্থলে। এ ছাড়া বৃষ্টিপাতের কারণে সড়কে মানুষের উপস্থিতিও ছিল কম। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় এদিন পুরো সপ্তাহের তুলনায় তাদের আয় বেশি হয়। কিন্তু টানাবৃষ্টির কারণে তাদের অনেকেই পণ্য নিয়ে বের হতে পারেননি। যারা বের হয়েছেন, তাদের খুব একটা বেচাবিক্রি নেই।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ অবস্থান করছে। এর প্রভাবে আট বিভাগে তিন দিন বৃষ্টি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ ছাড়া পাঁচ দিনের আবহাওয়ার অবস্থায় বলা হয়েছে, এ সময়ের শেষের দিকে দেশের দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

পূর্বাভাসে আবহাওয়ার সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থানরত লঘুচাপটি বর্তমানে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমী বায়ুর অক্ষ পূর্ব-উত্তর প্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর-বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। আজ শনিবার সকাল ৯টা থেকে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায়, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের দু-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে ফের টাঙ্গাইলের যমুনা নদীসহ জেলার ছোট-বড় সব নদ-নদীর পানি ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। টানা ভারী বৃষ্টির কারণে জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চলে রোপণকৃত ধানের চারা, শাক-সবজিসহ আবাদি ফসলের জমি এবং পুকুরও তলিয়েছে । এরআগে কয়েক সপ্তাহ ধরে নদীর পানি কমে কৃষকরা নতুন করে ধান চাষসহ রবি ফসল রোপণ শুরু করেছিল।

গাইবান্ধা থেকে সংবাদদাতা জোবায়ের আলী আমাদের জানিয়েছেন. অবিরাম বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে ডুবে গেছে তিস্তার নিচু এলাকা। গত বুধবার রাত হতে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর, কাপাসিয়া, দহবন্দ, শান্তিরাম, কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর চরাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে ভাঙন। সুন্দরগঞ্জ পয়েন্টে বেসরকারি পানি মাপক যন্ত্রের তথ্য মোতাবেক তিস্তার পানি এখনও বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি হু হু করে ধেঁয়ে আসছে। আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে গোটা চরাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলা কন্টোলরুম সূত্রে জানা গেছে, ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ৫০০ হেক্টর জমির উঠতি আমনধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষেত। চরের রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ইতিমধ্যে অনেকে আশ্রয় কেন্দ্র, উচ্চ স্থান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। অনেকে বসতবাড়িতে অবস্থান করছে। বেলকা চরের শিপন মিয়ার ভাষ্য, তিস্তায় ব্যাপক হারে স্রোত দেখা দিয়েছে, ভেসে আসছে গাছপালাসহ বিভিন্ন জীবযন্তুর মৃতদেহ। এখনও চরের বসতবাড়িতে পানি ঢুকে নেই। তবে নিচু এলাকা ডুবে গেছে। পানি যে হারে ধেঁেয় আসছে, তাতে করে আশঙ্কা করা যাচ্ছে রাতারাতি চরের বসতবাড়িতে পানি ঢুকে পড়বে। বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। হরিপুর ডাঙ্গার চরের রাজ্জাক মিয়া বলেন, তার বসতবাড়ি আঙিনায় পানি ঢুকে পড়েছে। রাত নাগাত ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়বে। গত বুধবার রাত হতে বৃষ্টি পড়ছে, পরিজন নিয়ে কষ্টে রয়েছি। এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান ও নেম্বরগণ কোন প্রকার খোঁজ খবর নেয়নি।

রাজধানী ঢাকাতেও বৃষ্টির কারণে খেটে খাওয়া মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। রিকশা চালক কবির হোসেন বলেন, শুক্রবার ছুটির দিনে এমনিতেই রাস্তায় মানুষ নাই। আবার দুই দিনের বৃষ্টির কারণে প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হচ্ছে না। রিকশা চালাইয়া যা ইনকাম হচ্ছে, তা দিয়ে গ্যারেজের জমা দেওয়ার পর তিন বেলা খাবারের খরচও ওঠে না। ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে রাস্তায় বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করা হকাররাও পড়েছেন সংকটে। ক্রেতা না পেয়ে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা কাউসার জানান, সরকারি চাকুরে এবং অন্যান্য ব্যস্ত মানুষেরা পুরো সপ্তাহের বাজার করেন শুক্রবারে। সেই হিসাব করেই আজ একটু বেশি সবজি তুলেছেন তিনি। কিন্তু সে তুলনায় বিক্রি একেবারেই কম। তিনি বলেন, শুক্রবার দুপুরের আগেই অর্ধেকের বেশি সবজি বিক্রি করে ফেলি। কিন্তু বৃষ্টির কারণে আজ সকাল থেকে লোকজনের দেখা নাই। টানা বৃষ্টিতে সাভার ও আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। ডুবে গেছে রাস্তাঘাট, পানি ঢুকে পড়েছে বসতবাড়ি ও মার্কেটে। বাইপাইল করিম সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী নেছার উদ্দিন খান বলেন, টানা বৃষ্টি হচ্ছে। যেসব জিনিসপত্র নিচে রাখা ছিল, সব পানিতে ডুবে গেছে। বর্তমানে দোকানে হাঁটু পরিমাণ পানি। মাছের আড়তদার রবিন চন্দ্র বলেন, কি আর বলবো। রাত থেকে জেগে আছি। পানি আড়তে প্রবেশ করছে, দেখছি। কিন্তু কিছু করার নাই। কারণ আশপাশে সব জায়গায় পানি উঠেছে।

প্রাইভেটকার চালক কাউসার হোসেন বলেন, জামগড়া যাবো বলে সকালে ঢাকা থেকে এসেছি। এখানে এসে দেখি এক হাঁটু পানি। গাড়ির ভেতরে প্রায় পানি প্রবেশ করছে। শুনেছি রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় কোমর সমান পানি রয়েছে। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায় এক রাতের বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার একর আমন ধানের ক্ষেত ও আগাম চাষ করা শীতকালীন বিভিন্ন শাক-সবজির মাঠ। ভেসে গেছে শতাধিক মাছের খামার। এমনকি, পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় এবং মাটি সরে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তাঘাট, ব্রিজ ও কালভার্ট। বৃহস্পতিবার রাতের টানা বৃষ্টিতে উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের নয়াপাড়া, ধামলই, গলদাপাড়া, নান্দিয়া সাঙ্গুন গ্রামের শত শত একর জমির আমন ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ধানক্ষেতে থৈথৈ করছে পানি। মাছ শিকারিরা বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন।
বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ময়মনসিংহ নগরীর রাস্তাঘাট। পানি উঠেছে বাসাবাড়ি ও দোকানে। বাসায় পানি ওঠায় অনেকের রাত কেটেছে নির্ঘুম। নগরী ব্রাহ্মপল্লী এলাকায় হাঁটু পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন পলি (৬৫) নামের এক বৃদ্ধ। এছাড়া উপজেলায় তলিয়ে গেছে ধানক্ষেত। ভেসে গেছে পুকুর-ঘেরের মাছ। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। কখনো ঝিরিঝিরি, কখনো মুষলধারে শুরু হওয়া উত্তরের এ বৃষ্টি রাজশাহীকে ডুবিয়ে এবার চলছে ময়মনসিংহে। এতে পুরো শহরজুড়ে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। দুদিন ধরে শুরু হওয়া এ বৃষ্টি এখনও ঝরছে ক্ষণে ক্ষণে বিরতি দিয়ে। এতে এ অঞ্চলের মানুষ পড়েছেন বিপাকে। নগরের বর্ণালি মোড়ের দক্ষিণ পাশে এখনো পানি। গতকাল সেখানে পারাপারের জন্য নৌকা ব্যবহার করা হয়েছিল। নগরের মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের সামনের সড়ক এখনো ডুবে রয়েছে। সেখান থেকে নগরের অচিনতলা পর্যন্ত একই অবস্থা। নগরের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের তেরখাদিয়া কলেজপাড়ার প্রায় ১০০ বাড়িঘরে এখনো পানি রয়েছে। এই মহল্লার কলি বেগম ও সাবিনা বেগম বলেন, তাঁদের বাসায় চুলা জ্বালানোর উপায় নেই। বাধ্য হয়ে চার-পাঁচটা পরিবার একসঙ্গে উঁচু একটি জায়গায় চুলা করে খিচুড়ি রান্না করে খাচ্ছেন। এখনো তাঁদের ঘর থেকে পানি নেমে যায়নি।
বৃহস্পতিবার সকাল ছটা থেকে শুক্রবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৩৭৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে ময়মনসিংহে। আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, স্বাধীনতার পর ময়মনসিংহে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি। শুধু যে ময়মনসিংহ জেলা, তা নয়; ওই বিভাগের পার্শ্ববর্তী হাওড়বেষ্টিত জেলা নেত্রকোনাতেও একই সময়ে ৩৫১ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের হাওড় উপজেলা নিকলিতেও বৃষ্টি হয়েছে ৩১১ মিলিমিটার। এতে, বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে; তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল।

এর আগে, বুধবার ও বৃহস্পতিবারের ভারি বৃষ্টিতে ভেসে গেছে উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহী। বুধবার বেলা ১টা থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ১টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৪৫.৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গত ১০ বছরের মধ্যে এটি রাজশাহীতে একদিনে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত।

দফায় দফায় বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরীর অধিকাংশ এলাকায়। নিত্যপ্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, তাদের বৃষ্টির পানি মাড়িয়েই কাজকর্ম শেষে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। তবে, বৃষ্টির সে ধারা এখন অনেকটাই থেমে গেছে। শুক্রবার সকাল ৯টার তথ্য বলছে, শেষ ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীতে ৮১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আগের দিন সৃষ্ট জলাবদ্ধতা কাটেনি এখনও। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় দ্রুত পানি নেমে যেতে পারছে না।

https://www.dailysangram.info/post/537354