৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ১১:১৪

গলার কাঁটা মার্জিন ঋণ

রঞ্জন তালুকদার (ছ্দ্ম নাম)। সঞ্চয়ের ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন পুঁজিবাজারে। নিজ পুঁজিতে দুই বছরে লাভসহ তার বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১ কোটি টাকা। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু মার্জিন ঋণের ফাঁদে পড়েন রঞ্জন। কয়েক ধাপে ৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন পড়েছেন বিপদে। ইতোমধ্যে ঋণের সুদও পরিশোধ করেছেন ৫ কোটি। চক্রবৃদ্ধি সুদে এখনো ঋণ ৫ কোটিই রয়ে গেছে। লাভতো দুরের কথা পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা এ বিনিয়োগকারী। কিন্তু এখনো ৫ কোটি টাকা দেনা কিভাবে পরিশোধ করবেন এ নিয়ে ঘুম নেই রঞ্জন তালুকদারের। রঞ্জন বলেন, ঋণ সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল না। হঠাৎ করে ব্রোকার থেকে আমাকে বলা হলো, মার্কেট ভালো আছে, লোন নিয়ে ব্যালেন্স করে ফেললে ভালো হবে। আমি জানি না যে মার্কেট এমন হবে। লোন নিয়ে শেয়ার কিনে এখন আমি ধরা। ধরুন আমি ৫০ টাকা লোন নিয়েছি। যদি তার সুদ ৫ টাকা হয়, সেটা আগেই কেটে নিয়ে ঋণের সঙ্গে যোগ হচ্ছে, অর্থাৎ ৫৫ টাকার ওপর সুদ কাটছে। এভাবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বাড়ছে। এ যেন এক রকম গ্রাম্য দাদন ব্যবসার মতোই সুদের ব্যবসা।

আরেক বিনিয়োগকারী শহীদুল ইসলাম (ছদ্ম নাম)। তিনিও মার্জিন ঋণে বিপাকে। লোভে পড়ে আসল ও মুনাফার টাকার সঙ্গে মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেন। কিন্তু বাজার ধসে ২৮ লাখ টাকার বিনিয়োগ নেমে দাঁড়িয়েছে তিন লাখে। অর্থাৎ ২৫ লাখ টাকা হাওয়া। রঞ্জন ও শহীদুলের মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই সঞ্চয়ের সমপরিমাণ মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। এরপর যখন দরপতন শুরু হয়, ব্রোকাররা নিজেদের টাকা তুলে নিতে মার্জিন অ্যাকাউন্টের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সসেল) করে দেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়, ধস নামে বাজারে। আর তাই মন্দা শেয়ারবাজারে গলার কাটা হিসেবে দেখা দিয়েছে মার্জিন ঋণ। সামগ্রিকভাবে বাজারের জন্যও বড় ধরনের ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ বাড়ায় বিপাকে বিনিয়োগকারীরা। যদিও ফোর্সসেল বন্ধ করতে বিএসইসি এক অনুপাত এক (১ : ১) মার্জিন ঋণের বিধান চালু করেছে। আপাতত দৃষ্টিতে ফোর্সসেলের ক্ষতি থেকে বাঁচতে কমিশন এটি করেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বর্তমানে বাজারে মার্জিন ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। বিভিন্ন সময়ে বাজার অতিমূল্যায়িত হওয়ার ক্ষেত্রেও এই ঋণ দায়ী। কারণ, মৌলভিত্তির বাইরে দুর্বল কোম্পানিতেও ঋণ নিয়ে কারসাজি হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১০ সালের ধসের পর মার্কেট ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, কেবল মার্জিন ঋণের কারণে। এর কারণে বাজারে ফোর্সসেল হয়, লাখ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হন। এখনও ছোট ছোট যত ধস হচ্ছে তা ফোর্সসেলের কারণে। তাদের মতে, যত দূর সম্ভব ঋণ না করেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। পুঁজিবাজারে ঝুঁকি থাকবেই। ঋণ না করে সঞ্চিত অর্থ থেকে বিনিয়োগ করা ভালো। যারা মার্জিন লোন নেন, তারা লোভে পড়ে নেন। দরপতনে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। যা বাংলাদেশের মতো দুর্বল বাজারের জন্য এটি মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একই সঙ্গে চক্রবৃদ্ধি সুদে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাই মার্জিন ঋণে বিনিয়োগকারীদের চক্রবৃদ্ধি সুদ বাতিল করা উচিত কলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেছেন, আমরা সবসময়ই মার্জিন ঋণকে নিরুৎসাহিত করি। যার ক্ষমতা নেই তার কেন অতিরিক্ত সুদে বিনিয়োগে আসতে হবে। ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। আর ঋণ নিলে সুদ দিতে হবে এটাই নিয়ম। যদিও না নেয়াই উত্তম। তবে চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ/অস্বাভাবিক হারে কেউ সুদ নিলে তা ক্ষতিয়ে দেখা হবে। এটা অন্যায়।

সূত্র মতে, গ্রাহককে শেয়ার কিনতে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউজ থেকে যে ঋণ দেয়া হয়, একে মার্জিন ঋণ বলে। ব্রোকারেজ হাউজ দাম কমে গেলে গ্রাহকের শেয়ার তারা ফোর্সড সেল (বাধ্যতামূলক বিক্রি) করে। বর্তমানে মার্জিন ঋণের এই হার ১ ঃ ০ দশমিক ৮। এর অর্থ হলো কোনো গ্রাহকের ১০০ টাকা থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজ থেকে আরও ৮০ টাকা ঋণ নেয়া যাবে। যদিও বর্তমানে এই মাত্রা কিছুটা কম। যদিও ২০১০ সালে গ্রাহকের বিনিয়োগের বিপরীতে দশগুণ পর্যন্ত ঋণ দিয়েছিল বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউজ। এর ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা পুরো দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৩৩ লাখ বেনিফিশিয়ারি ওনার্সধারী (বিও) বিনিয়োগকারীর মধ্যে মার্জিন ঋণ নেয়াদের নেগেটিভ ইক্যুইটি ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মার্জিন ঋণের কারণে বাজারে অস্বাভাবিক উত্থান-পতন হয়। ফলে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও পুঁজিবাজারের মর্যাদাক্ষুন্ন হয়। বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে মার্জিন ঋণ পরিহার করা উচিত। তাহলে প্রকৃত বিনিয়োগ বাড়বে, কমবে কারসাজি। ২০১০ সালের পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনেও পুঁজিবাজারে ধসের পেছনে মার্জিন ঋণকে দায়ী করা হয়। সেখানে বিনিয়োগকারীদের মার্জিন ঋণ পরিহারের সুপারিশও করা হয়।

পুঁজিবাজার ২০১০ সালের পরিস্থিতি থেকে উন্নতি করলেও এখনো ক্ষতিতে রয়েছেন মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগকারীরা। রঞ্জন ও শহীদুলের মতো লাখ লাখ বিনিয়োগকারী মার্জিন ঋণ নিয়ে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই সঞ্চয়ের সমপরিমাণ মার্জিন ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন। এরপর যখন দরপতন শুরু হয়, ব্রোকাররা নিজেদের টাকা তুলে নিতে মার্জিন অ্যাকাউন্টের শেয়ার জোরপূর্বক বিক্রি (ফোর্সসেল) করে দেন। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়, ধস নামে বাজারে।
প্রতিদিনিই কোন না কোন বড় শিল্পগ্রুপকে যারা অর্থ আত্মসাত বা খেলাপি হয়েছেন এমন প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ছাড় দিয়ে বিশেষ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। অথচ শেয়ারবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা ২০১০ সালের ধস এবং মার্জিন ঋণ নিয়ে চক্রবৃদ্ধি সুদ টানতে টানতে নিস্ব হয়ে পড়েছেন। এসব ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা আজ পর্যন্ত কোন সুবিধা পাননি। বা তাদের জন্য নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, যত দূর সম্ভব ঋণ না করেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা উচিত। পুঁজিবাজারে ঝুঁকি থাকবেই। ঋণ না করে সঞ্চিত অর্থ থেকে বিনিয়োগ করা ভালো। যারা মার্জিন ঋণ নেন, তারা লোভে পড়ে নেন। দরপতনে তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

রঞ্জন বলেন, লোভে পড়ে মার্জিন ঋণ নিয়েছিলাম। এখন আমার সঞ্চয় ও মুনাফা দুই-ই গেল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে যখন এসব কথা বলছিলেন তখন রঞ্জনের পাশে থাকা আরেক বিনিয়োগকারী শহিদুল বলেন, মার্জিন ঋণ আমার সঞ্চয়, পেনশন ও পরিবারের সুখ সব কেড়ে নিয়েছে। আমিও প্রথমে সঞ্চয়ের পাঁচ লাখ, পরে পেনশনের সাত লাখ টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করি। মাত্র দেড় মাসে ১২ লাখে মুনাফা হয় চার লাখ টাকা। লোভে পড়ে ২০১০ সালে ১১ লাখ টাকা ঋণ নেই। অক্টোবরে বিনিয়োগের পর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রকৃত বিনিয়োগ, মুনাফা আর মার্জিন ঋণের টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ লাখ। ২০১০ সালের ধসে সেই ২৮ লাখ নেমে আসে মাত্র তিন লাখে।

‘লোকসানে পড়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারিনি। পরিবারের খরচ কমাতে ঢাকার মতিঝিলের বাসা ছেড়ে এখন নারায়ণগঞ্জে থাকি। মনে অশান্তি, পরিবারেও অশান্তি।’ হতাশার সুরে তিনি বলেন, এরপর থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছি। ঋণ মানেই বিষ পান। গত এক যুগে সেই তিন লাখ টাকা এখন পাঁচ লাখে দাঁড়িয়েছে। যেদিন হারানো আসল তুলতে পারব, সেদিনই সালাম দিয়ে মার্কেট ছেড়ে দেব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সিকিউরিটিজের ট্রেডার বলেন, ২০০৯-১০ সালের দিকে মার্জিন ঋণ না দিলে হাউজে বিনিয়োগকারীরা থাকত না। অন্য হাউজে চলে যেত। চাকরি বাঁচানোর জন্য স্যারদের অনুরোধ করে মার্জিন ঋণ দিতে হয়েছে।

তিনি বলেন, মার্জিন ঋণ নিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী মুনাফা করেছেন। সেই মুনাফা তুলে যারা অন্য খাতে ব্যয় করেছেন তারাই গেইন হয়েছেন। কিন্তু যারা মার্কেটেই বিনিয়োগ করেছেন, তারা ধরা খেয়েছেন। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেছেন। গত এক যুগেও সেই ক্ষতি তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

https://dailyinqilab.com/national/article/607111