৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ১১:১২

এক বছরে ১১% কমেছে বৈদেশিক অর্থ সহায়তা

দেশে নতুন অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বৈদেশিক অর্থ সহায়তা ১২ কোটি ৫৩ লাখ ডলার কমেছে। প্রতি ডলার ১১০.৫০ টাকা মূল্য ধরলে তা দাঁড়ায় এক হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় যা ১১ শতাংশ কম। এই দুই মাসে বিদেশি ঋণের অর্থছাড় দাঁড়িয়েছে ৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলারে।

গত বছর একই সময়ে তা ছিল ৮৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে অর্থছাড় কমেছে। তা ছাড়া ঋণ পরিশোধে আরো বেশি চাপের মুখে পড়তে হবে বলেও মনে করছেন তাঁরা।

ইআরডির তথ্য বলছে, আগস্ট শেষে গত বছরের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। অর্থাৎ এ বছর ঋণ পাওয়ার চেয়ে ঋণ পরিশোধের চাপ গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে। চলতি বছর আগস্ট শেষে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০ কোটি ডলার বা চার হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। অথচ গত বছর একই সময়ে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ২৮ কোটি ৯৭ লাখ ডলার বা দুই হাজার ৭৩১ কোটি টাকা।

অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৩৮.২ শতাংশ বেশি। ঋণ থেকে সুদকে আলাদা করলে দেখা যায়, সুদের চাপও দ্বিগুণ হয়েছে। আগস্ট শেষে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলার বা এক হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা।

ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের শুরু থেকে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে উন্নয়ন প্রকল্পে বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়েছে। উন্নয়নকাজে ব্যবহৃত নির্মাণসামগ্রীর মূল্য ঊর্ধ্বমুখী ছিল।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও এলসি ওপেনিং নিয়ে অনেক প্রকল্পে জটিলতায় পড়তে হয়েছে। এ কারণে ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হার কম ছিল। এ ছাড়া সক্ষমতার অভাবে এডিপিতে বৈদেশিক ঋণের বরাদ্দের ব্যবহার এর আগের অর্থবছরের চেয়ে কিছুটা কম ছিল।

ইআরডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঋণদাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে এই দুই মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে জাপান। এ দেশের কাছ থেকে ছাড় হয়েছে ৩০ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবির কাছ থেকে। এ সংস্থার কাছ থেকে ঋণের অর্থছাড় হয়েছে ১৫ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। তৃতীয় সর্বোচ্চ করেছে বিশ্বব্যাংক। এ সংস্থার আইডিএ প্রগ্রামের অর্থছাড় হয়েছে ১৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের বেশির ভাগই এসেছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বড় উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা থেকে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে।

চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে অর্থছাড় কম হলেও এই সময়ে ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে প্রায় চার গুণ। আগস্ট শেষে অনুদানসহ বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ১১৪ কোটি ৪৩ লাখ ডলার। গত বছর একই সময়ে প্রতিশ্রুতি ছিল ৩০ কোটি ৪৯ লাখ ডলারের। এ সময়ে পাইপলাইনে থাকা সম্ভাব্য ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৭০ কোটি ডলারের বেশি।

ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে সুদের হার বৃদ্ধির ফলে সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের চাপ বেড়েছে। এতে ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ৩২.৪ শতাংশ বেশি।

ইআরডির হিসাবে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের সুদ ও আসল মিলিয়ে ২.৬৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে। এর মধ্যে সুদ হিসাবে পরিশোধ করেছে ৯৩৫.৬৬ মিলিয়ন ডলার আর আসল পরিশোধ করেছে ১.৭৩ বিলিয়ন ডলার। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার আসল ও সুদ বাবদ পরিশোধ করেছে ২.০১৭ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে আসল ১.৫২ বিলিয়ন এবং সুদ ৪৯১ মিলিয়ন ডলার।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে ইআরডির এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) বেড়ে ৫ শতাংশের বেশি হয়েছে। এ কারণে বাজারভিত্তিক ঋণের জন্য বাংলাদেশকে এখন ৫ শতাংশের বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের আগে এই রেট ছিল ১ শতাংশের কম।

ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে পাইপলাইনে বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ৪৪.৭ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ ঋণের জন্য সরকার এরই মধ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার সময় ও মেগাপ্রজেক্টগুলোর কারণে আমাদের বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ বেড়েছিল। এখন যেহেতু অনেক মেগাপ্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে, তাই ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে ঋণপ্রবাহ কমলেও বাড়ছে ঋণ পরিশোধের চাপ। কারণ বেশির ভাগ বড় প্রকল্পের কাজ শেষ। ঋণ পরিশোধের গ্রেস পিরিয়ডও শেষ। তাই এখন ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে, ভবিষ্যতেও বাড়বে।

https://www.kalerkantho.com/online/business/2023/10/04/1323753