৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ১১:১১

ছাত্রলীগের শাসন

১৭ নেতার দখলে সাত হলের ১০৮০ কক্ষ

কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পরও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সাতটি আবাসিক হলে চলছে ‘ছাত্রলীগের শাসন’। ১১টি উপগ্রুপের ১৭ নেতার দখলে রয়েছে ১ হাজার ৮০টি কক্ষের সব। ২৮ হাজার শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এখনও চলছে তাদের দাপট। গত এক বছরে দুই দফা বিজ্ঞপ্তি দিয়েও হলের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেনি প্রশাসন। ফলে বহাল তবিয়তে ছাত্রাবাসে আছে অছাত্র ও বহিষ্কৃতরা। তবে চবির ১১টি হলের বাকি চারটি মেয়েদের। এখানকার কক্ষগুলোও ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ন্ত্রণে।

এর আগে হলে থাকার জন্য ১০০ টাকা ফি দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হয়। ছাত্রদের সাতটিসহ মোট ১১টি আবাসিক হলে থাকা ৪ হাজার ৯২৫ আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়ে ২ হাজার ৭৮০টি। ফলে তা আবেদনেই সীমাবদ্ধ।
অছাত্রদের হল থেকে বের করার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার বলেন, আবাসিক হলে অবস্থানরত অছাত্রদের তালিকা করছেন প্রভোস্টরা। তালিকা তৈরি হলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হল দখলে ১১ উপগ্রুপ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ দুই ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষ সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। অন্য পক্ষ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। এই দু’পক্ষ আবার ১১টি উপগ্রুপে বিভক্ত। বিজয় ও সিএফসি শিক্ষা উপমন্ত্রীর অনুসারী। সিক্সটি নাইন, ভার্সিটি এক্সপ্রেস, কনকর্ড, বাংলার মুখ, একাকার, রেড সিগন্যাল, উল্কা, এপিটাফ ও স্বাধীনতা সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী। শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক এসব উপগ্রুপই দখল করে রেখেছে সাতটি হল। সেগুলো হলো– শাহ আমানত, আলাওল, শাহজালাল, শহীদ আবদুর রব, মাস্টারদা সূর্য সেন, এ এফ রহমান ও সোহরাওয়ার্দী হল। এই হলগুলোতে ১ হাজার ৮০টি কক্ষে আসন আছে ২ হাজার ৭২৫টি। সব কক্ষই চলছে ছাত্রলীগের তৈরি নিয়মে। কোন কক্ষে কে থাকবে, সেটিও ঠিক করে দিচ্ছে তারা।

ছাত্রাবাসে ছড়ি ঘুরাচ্ছে অছাত্র ও বহিষ্কৃতরা
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, ছয় বছরে স্নাতক ও দুই বছরে স্নাতকোত্তর শেষ করতে হবে। এরপর আর ছাত্রত্ব বজায় থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলেও অবস্থান করা যাবে না। কিন্তু চবির হল দখলের নেতৃত্বে থাকা নেতাদের বেশির ভাগই ক্যাম্পাসে আছে ১০ থেকে ১২ বছর ধরে। ছাত্রত্ব ধরে রাখতে স্বল্পমেয়াদি বিভিন্ন কোর্সে ভর্তি হয়েছে তারা। বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ৩৭৬ সদস্যবিশিষ্ট ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তার পরও ক্যাম্পাসে ছড়ি ঘুরাচ্ছে ওরা। অথচ বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ নেতাদের কেউই নিয়মিত ছাত্র নন। নানা কৌশলে ছাত্রত্ব ধরে রেখে হল দখল করে রেখেছে তারা।

গ্রুপভিত্তিক হলের নেতৃত্বে আছে যারা
চবি ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে গত পাঁচ বছরে সবচেয়ে বেশি শিরোনাম হয়েছে পাঁচটি গ্রুপ– চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার (সিএফসি), সিক্সটি নাইন, বিজয়, ভার্সিটি এক্সপ্রেস ও বাংলার মুখ। চবি ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি রেজাউল হক রুবেল নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন সিএফসি গ্রুপের। তাঁর সঙ্গে ছিলেন নাছির উদ্দীন সুমন, আরাফাত রায়হান ও খালেদ মাসুদ। তাদের সহায়তায় শাহ আমানত হলের সব কক্ষ দখল ছিল সভাপতির নেতৃত্বে।

তবে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য নিজের গ্রুপসহ চবি ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতারা রুবেলকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন। পরে এই গ্রুপটি দুই ভাগ হয়ে যায়। সিএফসি গ্রুপের সভাপতির বিরুদ্ধে নেতৃত্ব গড়ে তোলেন বিলুপ্ত কমিটির সহসভাপতি মির্জা খবির সাদাফ। শাহ আমানত হলের আধিপত্যও চলে যায় তাঁর হাতে। রুবেল দখল নেন শহীদ আব্দুর রব হল। গত ২৪ সেপ্টেম্বর কমিটি বিলুপ্তির পর এখন রব হলের নেতৃত্বে আছেন ইতিহাস বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের আহসান হাবিব সোপান।

বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুর দখলে শাহজালাল হল। সাবেক নেতা হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তাঁর অধীনেই আছে এই হল। তাঁর সঙ্গে আরও আছেন রাজু মুন্সি, শামসুজ্জামান সম্রাট ও সাইদুল ইসলাম। অন্যদিকে বিজয় গ্রুপের নেতৃতে বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইলিয়াছ। তাঁর দখলে আলাওল হল। আধিপত্য আছে এ এফ রহমান হলেও। তাঁর সহায়তায় আছে নয়ন চন্দ্র মোদক ও আল আমিন। অন্তর্কোন্দলের জেরে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে দুই ভাগ হয়ে যায় বিজয় গ্রুপ। এই গ্রুপের আরেক ভাগের নেতৃত্বে আছেন সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর দখলে রয়েছে সোহরাওয়ার্দী হলটি।

এ ছাড়া ভার্সিটি এক্সপ্রেস গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন প্রদীপ চক্রবর্তী ও মুজিবুল ইসলাম, রেড সিগন্যাল গ্রুপের নেতা রাকিবুল হাসান দিনার, বাংলার মুখ গ্রুপের নেতা আবু বকর তোহা, কনকর্ড গ্রুপের নেতা আবরার শাহরিয়ার, একাকার গ্রুপের নেতা মঈনুল ইসলাম ও এপিটাফ গ্রুপের নেতা সাজ্জাদ হোসেন পিনন। উল্কা গ্রুপটির বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গত এক বছরে তেমন কোনো নেতৃত্ব দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন অন্য গ্রুপের নেতারা। এ এফ রহমান ও আব্দুর রব হলে কক্ষ ভাগাভাগি করে দখলে ভিএক্স গ্রুপ ও বাংলার মুখ গ্রুপ। একাকার গ্রুপের নেতাকর্মীরা থাকেন আব্দুর রব ও শাহজালাল হলে। অন্যদিকে এপিটাফ গ্রুপের নেতাকর্মীরা থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হলে। তবে এই গ্রুপের নেতা সাজ্জাদ আনামের দাবি বৈধভাবেই এই হলে ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের ছাত্ররা থাকেন।

যে কারণে ব্যর্থ প্রশাসন
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর হল দখলে থাকার ফলে গত সাত বছরে বৈধ উপায়ে আবাসিক হলের সিট বরাদ্দ দিতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন। এ সময় দু’বার হলের আসন বরাদ্দের জন্য ফি নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আসন বরাদ্দ দিতে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এবারও ব্যর্থ হয়েছেন তারা। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বহিষ্কৃত এক ছাত্রের কক্ষ সিলগালা করতে গিয়ে বিক্ষোভের শিকার হন আলাওল হলের প্রাধ্যক্ষ ও হাউস টিউটররা। বৈধ উপায়ে সিট বণ্টনের কাজ শুরু করতে ছাত্রত্বহীন ছাত্রলীগ নেতাদের কাছেও ধরনা দিয়ে লাভ হয়নি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে আবাসিক হল খালি করতে ছাত্রলীগের সব গ্রুপের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি। তবে সেই বৈঠকও ভন্ডুল হয় দু’পক্ষের বাগ্‌বিতণ্ডার ফলে। মূলত ছাত্রলীগের ব্যাপারে কঠোর হতে না পারার কারণেই বারবার উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে প্রশাসন।

যা বলছেন নেতারা ও হল কর্তৃপক্ষ
সিক্সটি নাইন গ্রুপের নেতা সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘চবিতে সাধারণত দেখা যায় কোনো কমিটি বিলুপ্ত হওয়ার পর আরেকটি কমিটি আসা পর্যন্ত সাবেক নেতাদের আধিপত্য থাকে। তাই গ্রুপ এবং ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে এখনও টিপু ভাইয়ের নেতৃত্বে আছে।’ বিজয় গ্রুপের নেতা মোহাম্মদ ইলিয়াস বলেন, কমিটি বিলুপ্তির পর আলাওল হলের নেতৃত্বে এখনও কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে নতুন কমিটি এলে পরিবর্তন আসতে পারে। বিজয় গ্রুপের আরেকটি ভাগের নেতা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সোহরাওয়ার্দী হলে কোনো অছাত্র নেই।

যা বলছেন প্রাধ্যক্ষরা
আলাওল হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ফরিদুল আলম বলেন, অছাত্রদের তালিকার বিষয়টি জানা নেই। তবে ২৫ সেপ্টেম্বর আলাওল হলে প্রাধ্যক্ষ ও হাউস টিউটরদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমরা প্রক্টরিয়াল বডিকে অভিযোগ দিয়েছি। তারা এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে। শাহজালাল হলের প্রাধ্যক্ষ মো. জামাল উদ্দীন বলেন, যে গতিতে হলে বৈধ ছাত্র উঠানোর কাজ হওয়ার কথা, নানা কারণে সেটি হচ্ছে না। তবে আমাদের আন্তরিকতায় কোনো ঘাটতি নেই।

https://samakal.com/whole-country/article/2310199551