৩ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:০০

ক্রমাগত একা হয়ে উঠছে মানুষ

-জাকির আবু জাফর

হয়তো চোখ কপালে তুলে বলবেন- মানুষ একা হয়ে উঠছে! কী বলছেন এসব! আজব কথা! এখন যোগাযোগ বিজ্ঞানের যুগ। এখানে ওখানে বলুন। দূরে কাছে বলুন! দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তের কথা বলুন! মুহূর্ত মাত্র। হয় মানুষ পৌঁছে যাচ্ছে। নয়তো মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে সব।

পৃথিবীতে বসে চাঁদের মাটির ঘ্রাণ নিচ্ছে মানুষ। মঙ্গলের লোহিত লাভা জ্বলে উঠছে পৃথিবীর কম্পিউটারে। আরো দূরের গ্রহও নিকট হয়ে উঠছে মানুষের! কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের খবর মাটির পৃথিবীতে নিয়ে আসছে যন্ত্র। বিশ্বের কোথায় কখন কি হচ্ছে এক লহমায় পেয়ে যাচ্ছে মানুষ। এ ছাড়া সঙ্গীতের মূর্ছনায় চঞ্চল মন। সংলাপের শব্দ বেশ উঁচু। রাজনীতিকদের হুমকি ধামকি আর ব্যঙ্গাত্মক বাক্যের মহড়া অতি চড়া।

এত ডামাডোলের পৃথিবীতে একা কোথায় মানুষ! কী করে একা হয়! একাকিত্বের সুযোগ কোথায়, যেখানে মুঠোফোন যন্ত্র শরীরের অঙ্গের মতো সঙ্গী! বিশ্ব তো এখন এই মুঠোফোনের ছোট্ট বুকের মধ্যে। মানুষের হাতের মুঠোয় জগতটি! উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম এমনকি আকাশ থেকে পাতাল সবই হাতের তালুর আওতায়।

ইচ্ছে করলেই বিচরণ করা যায় পৃথিবীর যেকোনো অঙ্গের সাথে। হ্যাঁ, ইচ্ছে-ই তো! বাকিটুকু একটি আংগুলের স্পর্শ মাত্র। তারপর চোখের সামনেই ভাসতে থাকে ইচ্ছের রঙ। ক্ষুদ্র একটি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে- যা চাই।

সোশ্যাল মিডিয়া বলে কথা। কিংবা সোশ্যাল কমিউনিকেশন। এই ‘সোশ্যাল কমিউনিকেশন’- এর একটি ঋষ্টপুষ্ট বাংলা হলো- ‘সামাজিক যোগাযোগ’। আরো একটি শব্দ যোগ করে ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’ বলেন কেউ কেউ! আলাদা নাম তো আছেই- ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ভাইভার, ইমো, ম্যাসেঞ্জার, সিগন্যাল আরো আরো কত কী। এক কথায় একে বলে নেট দুনিয়া। নেট দুনিয়া মানেই রঙিন দুনিয়া। এখানে রঙের ছড়াছড়ি। সামান্য বিষয়ও হয়ে ওঠে অসামান্য। আবার বিশাল ঘটনাও ক্ষুদ্রতার বিন্দু হয়ে ওঠে।

তো এই যে রঙিন দুনিয়া একে উপেক্ষা করতে পারছে কেউ! পারা সম্ভব কি! না অসম্ভব। অসম্ভবের জগৎ যখন হাতের মুঠোয় তখন মানুষ একাকিত্বের দুঃসহতায় ভুগবে এটি কি মানা যায়!

মানা না মানার গল্প ফেঁদে লাভ নেই। নেট দুনিয়া এক অশরীরী চুম্বক। এ চুম্বকের টান সব মনেই লাগে। এখানে কিঞ্চিৎ সম্পর্কও বিশাল আকর্ষণের।

ভয়াবহ বিষয়টি এখানেই- এ নেট দুনিয়ায় যে মানুষ যত সক্রিয় সে তত একা। যে যত বেশি বিচরণ করে সে তত বেশি নিঃসঙ্গ।
কিন্তু কেন?

তার আগে বুঝতে হবে কেন এতসব যোগাযোগ মাধ্যমের পয়দা হলো। কেন জন্মালো এত যোগাযোগ-পদ্ধতি!
সত্যি এটি- এতসব যোগাযোগ মাধ্যমের উদ্ভব হয়েছে কেবল মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে। মানুষের জীবনটি সহজ করার প্রয়োজনে। মানুষ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাওয়ার আয়োজনে। তার চেয়ে বড় কথা- গতকালের চেয়ে আজ আরো আধুনিক হওয়ার বাসনা থেকেই এত আবিষ্কার। এতো গতির খেলা। গতির এ খেলায় জড়িয়ে আরো আধুনিক হচ্ছে মানুষ।

গতির পৃথিবীতে বাস এখন। গতির এ চিন্তা থেকেই প্রগতির ধ্যান-ধারণা। প্রগতিশীল বা প্রগতিবাদী শব্দের জন্মও এখানে। গতির সঙ্গে মানিয়ে যারা নিজেকে সমসাময়িক করেন তারা প্রগতির দলে। যারা প্রগতির হয়ে যান তারাই সুশীল নামে পরিচিত।

জীবনকে গতির উদ্যমে তুলে দেবার তৃষ্ণায় কাতর মানুষের অভাব নেই। ঘরে বাইরে সমাজে রাষ্ট্রে এবং বিশ্বে এ প্রকৃতির মানুষ বেশুমার। এরা নিজেকে নিয়োজিত রাখেন নেট দুনিয়ার রঙিন জগতে।

না, নেট দুনিয়ায় বিচরণ অযৌক্তিক নয়। অযথার্থও নয়। অকারণ বলারও অবকাশ নেই। জীবনের পক্ষে জরুরি এটি। অন্তত এ সময়ে সামাজিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার চিন্তাও করা যায় না। মানুষের জীবন সহজ থেকে আরো আরো সহজ করে তুলেছে এ নেট দুনিয়া। তাই একে অস্বীকার কিংবা এড়িয়ে চলার সুযোগ কই!

কিন্তু যত সমস্যার তীর বিদ্ধ হয় এর অতি ব্যবহারে! অতিরিক্ত ব্যবহারে এবং অপ্রয়োজনে ব্যবহারে। এ তিনটি শব্দের চূড়ান্ত প্রতিনিধিত্ব করছে আমাদের তরুণ তরুণী। আমাদের যুব সমাজ। মধ্য বয়সীরাও এই আত্মঘাতের শিকার! এমনকি প্রৌঢ় মানুষ প্রায় বৃদ্ধ এমন সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। শিশু-কিশোরদের বিষয়টি আরো ভয়ানক।

এসব শ্রেণির মানুষই নেট আসক্ত। এদের জীবন প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে নেই। এদের রাত আর রাত নেই। দিনও নেই দিনের মতো। সুবহে সাদিকের সময় ঘুম নামে এদের চোখে। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে প্রায় দুপুর। বারোটা কিংবা তারও পরে হয় এদের সকাল। বারোটার দিকে হয় তাদের নাশতার আয়োজন। লাঞ্চের সময় হয় চারটার পর। রাতের খাবার রাত বারোটা পেরোলে শুরু হয়। এ যখন পরিস্থিতি কি আর নিয়ম। কি আর রসম। সূর্যের সাথে এদের সম্পর্ক নেই। চাঁদের সাথেও না। আলো অন্ধকার কখন হয় কখন যায় জানে না এরা। মানুষের সাথেও শেষাবধি সম্পর্ক থাকে না। থাকছে না। সম্পর্কের সুতোটি আটকে থাকে নেট দুনিয়ার রঙের সাথে।

নেটে কত শত চোখের সাথে বন্ধুত্ব। কত হাজার মুখের সাথে যোগাযোগ। অথচ নেট থেকে চোখ সরালেই কেউ নেই পাশে। কেউ নেই তার। কেউ তাকে নিয়ে ভাবার নেই। তাহলে কি নেট জগৎ কল্পনার জগৎ! হ্যা এমনই বলতে হবে। অন্তত এই প্রেক্ষিতে এটি কল্পনার জগতেরই একটি ধরন!

এই যে নেট জগতে ডজন ডজন বন্ধু। বাস্তবে বন্ধুহীন। ভীষণ একা। বুক ঠেলে বেরিয়ে আসে একাকিত্বের দীর্ঘশ্বাস। হতাশা নিরাশা ও দূরাশার দখলে জমে থাকে বুকের ভেতরটি। কারো কারো হতাশা এবং একাকিত্ব এমনই প্রচণ্ড রূপ নেয়, আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় তারা। কারো মনে চেপে বসে বিষণ্ণতা। কেউ সমর্পণ করে নেশার কাছে। কেউ কেউ চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলে। কেউ হারায় বিবেচনাবোধ। ফলে সে ছিটকে পড়ছে পরিবার থেকে। সমাজ থেকে। এমনকি রাষ্ট্র থেকেও। যত অন্যায় যেখানে হোক এতে তার কিছুই যায় আসে না। সে তার নিজস্ব ঘোরের ঘূর্ণিতে বিভোর। চার পাশের মানুষগুলো সরে যায় তার থেকে। ফলে সে হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ।
এভাবেই ক্রমাগত একা হয়ে উঠছে মানুষ।
লেখক : কবি, সাংবাদিক

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/781298