১০ ডিসেম্বর ২০২৩, রবিবার

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে- অধ্যাপক মুজিবুর রহমান

১০ ডিসেম্বর রবিবার দুপুরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান এর সভাপতিত্বে এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ-এর সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের ও মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জনাব হামিদুর রহমান আযাদ ও মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমীর জনাব আবদুর রহমান মুসা প্রমুখ।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) সর্ব প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানবাধিকার প্রণনয়ন করে গিয়েছেন তাঁর বক্তব্যে, কথায় এবং কাজে। তিনি বিশ্বের সর্বপ্রথম লিখিত একটি আদর্শ সংবিধান রচনা করে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন। রাসূল সা. প্রণীত সংবিধানই সত্যিকারের আদর্শ মানবাধিকার সংবিধান। নবী সা. বলেছেন, এক মুসলমানের রক্ত ওপর মুসলমানের জন্য হারাম এবং এক মুসলমানের সম্মান ওপর মুসলমানেরই সম্মান। বিশ্ববাসী যদি রাসূল সা. অনুসৃত এই নীতি গ্রহণ করতে পারে, তাহলে পৃথিবীতে সত্যিকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। একমাত্র ইসলাম মানার মধ্যেই প্রকৃত শান্তি নিহিত রয়েছে। আল্লাহ প্রদত্ত আইন বাদ দিয়ে কখনই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, সামাজিক সুবিচার, সাম্য, গণতন্ত্রেরে যে কথা বলা হয়, তা যদি সত্যি সত্যিই বাস্তবায়ন করা হতো, তাহেল দুনিয়ার চেহারা এমন হত না। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, কেন তোমরা এমন কথা বল, যা নিজেরা কর না। সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হল এমন কথা- যা নিজেরা বল, অথচ কর না। আজকের এই দিনে সারা বিশ্বে মানবাধিকারের কথা বলে, সামাজিক সুবিচারের কথা বলে, সমতার কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে বক্তব্য যারা দিচ্ছে, তারাই সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। সম্প্রতি ফিলিস্তিনের গাজায় যারা প্রকাশ্যে মানবাধিকারের কথা বলছে, তারাই নিরাপত্তা পরিষদের আনীত প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনে উস্কানী দিচ্ছে। এর চেয়ে নির্মমতা আর কী হতে পারে? যারা অস্ত্র সাপ্লাই দিয়ে মানুষ হত্যা করছে, তাদের মুখে মানবাধিকারের কথা মানায় না। এরা ধোঁকাবাজ, এরা মানবতার দুশমন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে গুম-খুন, হত্যা, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি নির্বিচারে চলছে। কিন্তু অপরাধীদের কোনো বিচার হচ্ছে না। অপরাধের বিচার না হলে সেখানে অপরাধ আরো বেড়ে যায়। বাংলাদেশে আজ তাই ঘটছে।

বাংলাদেশের মানুষ দুবেলা দুমুঠো ডাল ভাত খেয়ে সুখে শান্তিতে থাকার জন্য অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছিল। গণতন্ত্র হত্যা করে বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে জনগণের সে আশায় গুড়ে বালি। আবার দীর্ঘ আন্দোলন করে জনগণ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেই কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাও বাতিল করে দিয়ে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানো হল। এখন তারা দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো প্রহসনের নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এটা তো কোনো নির্বাচন নয়। এটা হল গণতন্ত্রের সাথে উপহাস। এটা হলো ভাগ-বাটোয়ারা ও সিট বন্টনের নির্বাচন। এই বেহুদা নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির কোটি কোটি টাকা খরচ করে দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে, ঘরছাড়া করে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। জামায়াতের বিরুদ্ধে ১৪,৮০১টি মামলা, আসামী ২,৭৪,৭৮৯ জন। এখনো কারারুদ্ধ আছেন প্রায় ৩ হাজার। বাড়িছাড়া ১,১০,১৪৫ জন নেতাকর্মী। সকল বিরোধীদল মিলে এই সংখ্যা অনেক গুণ বেশি।

তিনি আরও বলেন, জামায়াতসহ বিরোধীদলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে এবং দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। আসুন আমরা মানুষের তৈরি আইনের পরিবর্তে আল্লাহ প্রদত্ত বিধান ও রাসূল সা. প্রদর্শিত আইন দ্বারা পরিবার-সমাজ, দেশ ও জাতি পরিচালনা করি। আল্লাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন প্রতিষ্ঠা করি। তবেই মানুষ আখিরাতে মুক্তি ও সত্যিকার মানবাধিকার ফিরে পাবে এবং দুনিয়ায় সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের বাড়িবাড়ি বন্ধ করতে হবে। আজকে ঢাকা মহানগরী দক্ষিণে নেতাকর্মীদের ওপর গুলি চালিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়েছে এবং কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। জালিম সরকার এভাবে জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে বাংলাদেশকে বসবাসের অযোগ্য করে ফেলেছে। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, কথা বলার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বি। মাত্র দুই দিনে পিয়াজের দাম একলাফে বেড়ে আড়াইশ/তিনশ’ টাকা হয়ে গেছে। এদেশে সরকার বলে কিছু আছে কী? আসুন আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে বসবাসের উপযুক্ত করে গড়ে তুলি।

নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের বলেন, মানবাধিকারের প্রতিপাদ্য বিষয় স্বাধীনতা, সমতা, ন্যায়বিচার এগুলোর কোনোটিই আমাদের দেশে নেই। ফিলিস্তিনে নিঃসন্দেহে অনেক অনেক মানবিক বিপর্যয় চলছে। কিন্তু বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে নিরবে-সরবে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনে প্রায় ২১ হাজার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যূত। বর্তমান সরকারের আমলে বাংলাদেশের ২১ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ লক্ষ মানুষ আজ ঘরছাড়া। এ সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

নায়েবে আমীর মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম বলেন, আজকে মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ও অধিকার নেই। গুম-খুন নিত্য-নৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুডিশিয়াল কিলিং এর মাধ্যমে আমাদের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির দ- দিয়ে কার্যকর করা হয়েছে। গায়েবি মামলা দিয়ে শত শত নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হচ্ছে। দেশের কেউ শান্তিতে নেই। ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করা হয়েছে। দেশে মানবাধিকার বলতে কিছুই নেই।

ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম বলেন, গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার করে ক্ষমতাসীনরা নির্মমভাবে আমাদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। বিশ্বের মোড়লরা মানবাধিকার নিয়ে দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে চলেছে। এতে করে মানবজাতি হতাশ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের জালিম সরকারও রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে নাগরিকদের সকল অধিকার নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ভাত ও ভোটের অধিকার, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অধিকার, স্বস্তির সাথে বাঁচার অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার, সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার অধিকার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অধিকার, চাকরি-বাকরি ও আত্ম-কর্মসংস্থানের অধিকার, প্রশাসনের সেবা পাওয়ার অধিকার, সুশাসন পাওয়ার অধিকার, মানুষের জানমাল-ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার, শ্রমিক-মজুরের অধিকার তথা সব ধরনের অধিকার থেকে জাতিকে বঞ্চিত করা হয়েছে। রক্ষকই ভক্ষকে পরিণত হয়েছে। এভাবে গোটা দেশটাকে জুলুম-নির্যাতন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্ধকার আবাসে পরিণত করা হয়েছে।

সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জনাব হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, খুবই দুঃখজনক ব্যাপার রাজপথে মানবাধিকার দিবস পালন করতে গিয়েও হামলার শিকার হতে হচ্ছে। এটা একটা জঘন্যতম বর্বরতা ও অসভ্যতা ছাড়া আর কিছইু নয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে যে পরিমাণ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তার শতকরা ৭০ ভাগই লঙ্ঘিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা। আজকে কথা বলা যায় না। মত প্রকাশের যে স্বাধীনতা, তার অন্যতম প্রধান অংশ হল ভোটাধিকার, সে ভোটাধিকারের নামে চলছে প্রহসন। একদিকে চলছে হামলা-মামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং শত শত গুম-খুন। আজকে শিশুরাও রাস্তায় নেমেছে। তারা বলছে হয় আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও, না হয় বাবার লাশটি দাও। এই হল বাংলাদেশে মানবাধিকারের করুণ অবস্থা। জালেম কর্তৃত্ববাদী সরকারের সুশাসনের অভাবে আজকে দেশের এই পরিস্থিতি। সরকার দেশে দুর্নীতি-দুঃশাসন কায়েম করে রেখেছে। আমাদের ঈমানের দাবি, জিহাদের দাবি এই জালেমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।

সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, সরকারের দায়িত্ব মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা বিধান করা। অথচ সরকারই মানুষের এই সব অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এ সরকারের আমলে আমরা সকল রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। রাস্তায় পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে সরকার গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। জালিম সরকার আইন-শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে বিরোধীদলের চলমান আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে। মানবাধিকার দিবসের দাবি হল ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার এবং জীবন ও সম্পদ রক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা, যা বাংলাদেশে আজ সুদূর পরাহত।

তিনি আরও বলেন, সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী, ব্যারিস্টার আরমান আহমদ বিন কাসেম, হাফেজ জাকির হোসাইন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা আল মোকাদ্দাস ও মোহাম্মদ ওলিউল্লাহসহ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৫ জন নেতাকর্মী এখনো গুম হয়ে আছে। তাদের স্বজনরা আহাজারি করছে। কেউ লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছে না। বাংলাদেশে মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। সরকার মানবাধিকারের কথা বলে ক্ষমতায় এসে দেশ ও দেশের মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এ সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর করে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।