১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার

একজন নীরব, নিরলস, নিরহংকার ও নির্লোভ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী রাহিমাহুল্লাহ

২০০৫ সাল থেকে ২৯ বছর আগে কেন্দ্রিয় ইউনিটে তদানীন্তন আমীরে জামায়াত মাওলানা আবদুর রহীম ও সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফসহ আমরা ৮ জন রুকন ছিলাম। অন্যরা হলেন জনাব আবদুল খালেক, জনাব বদরে আলম, মাষ্টার শফিকুল্লাহ, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী, জনাব আমিনুর রহমান মঞ্জু ও আমি মাযহারুল ইসলাম। (উল্লেখ্য, কেন্দ্রিয় ইউনিটের রুকন সংখ্যা বর্তমানে ৯৬ জন, এর মধ্যে মহিলা ১৩ জন)। প্রথম থেকেই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী কেন্দ্রিয় দায়িত্বশীলদের মধ্যে ছিলেন একজন। ’৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি জয়েন্ট সেক্রেটারী এবং ’৮৪ সাল থেকে অন্যতম সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, প্রকাশনা বিভাগ, সফর সূচি প্রণয়ন, কেন্দ্রিয় অফিস বিভাগ সহ বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রিয় দায়িত্ব ছিল তার উপর। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অত্যন্ত সফলভাবে নিরবে তার দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে গেছেন। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তক্রমে আমাকে (গ্রন্থকারকে) কেন্দ্রিয় দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। আর সেই সুবাদে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী সাহেবের সাথে আমার নিত্য দিনের নিবিড় সাংগঠনিক ও দাপ্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা মরহুমের মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

গত দীর্ঘ ২৮ বছরে যাদের সাথে একত্রে বৈঠক করেছি, সংগঠনের বিভিন্ন কাজ এক সাথে করেছি, তাদের অনেকেই আজ এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাআলার এটা অমোঘ বিধান যে, কেউই চিরদিন বাঁচবে না। আমি, আপনি সকলকেই এ দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে। কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মাওত- সকল মানুষই মরণশীল। কিন্তু আমার দুঃখ এই যে--এ মৃত্যুগুলো আমি কাছ থেকে দেখেছি, কিংবা সর্বপ্রথম আমিই মৃত্যু সংবাদটি পেয়েছি এবং আপনজনদেরকে বেদনাদায়ক খবরটি পৌছিয়েছি। এটা যে কত বেদনাদায়ক তা ভুক্তভোগীরা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে মরমে মরমে উপলব্ধি করা কঠিন।

সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী গত ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৩ সালে ইন্তেকাল করেন। (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। সাংগঠনিক কাজে কুমিল্লার চান্দিনা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে গুরুতরভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে চান্দিনা হাসপাতালে নেয়া হয়। কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি তাঁর মাতা, স্ত্রী, দুই ভাই, পাঁচ ছেলে, চার মেয়ে ও অসংখ্য আত্নীয়-স্বজন ও হিতাকাঙক্ষী রেখে যান। 

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী ছিলেন একজন নীরব, নিরলস,নিরহংকার ও নির্লোভ এবং নিবেদিত প্রাণ নেতা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। ২৮ বছর বিভিন্ন অফিসিয়াল ও সাংগঠনিক কাজের সমন্বয় করার জন্য আমি তাঁর সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত ছিলাম। কিন্তু কোন সময় তাঁকে আমি রাগ করে কথা বলতে দেখিনি। কোন জুনিয়র ব্যক্তি তাঁকে কোন কড়া কথা বললেও তাঁকে কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করতে দেখিনি। তিনি ছিলেন একজন মাটির মানুষ। ছাত্র জীবনে মাটির মানুষ দিয়ে বাক্য রচনা করেছি। বাস্তবে মাটির মানুষ দেখেছি অধ্যাপক ইউসুফ আলী সাহেবকে।

আমি নিজে কখনো কখনো কোন কোন সময় শক্ত কথা বলেছি-কিন্তু তাঁকে দেখেছি একদম শান্ত থাকতে। একদিন একজন জুনিয়র দায়িত্বশীল অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী সাহেবের সাথে কোন এক প্রসঙ্গে যেভাবে রূঢ় কথা বললেন, তিনি অনেক সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও কোন কথা না বলে একদম চুপচাপ থাকলেন। চোখে মুখে তাঁর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

’৮৫ সালের কোন একদিন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী, অধ্যাপক আবদুল খালেক (অধ্যাপক আবদুল খালেক ছিলেন আরেক মর্দে মুজাহিদ। তিনি ছিলেন তখন জামায়াতের কেন্দ্রিয় কর্মপরিষদ সদস্য ও জামায়াতের জাতীয় নির্বাচন পরিচালক) এবং আমি শেরপুর জিলার শ্রীবরদীতে যাই এক জনসভায়। শেরপুর থেকে শ্রীবরদীর মাঝামাঝি পথে গিয়ে বাস আর যাচ্ছিলো না। শুনলাম সামনে ব্রীজ ভেঙে গেছে। সেখানে কোন রিকশাও নেই। আজ-কালের মত রাস্তাও তত উন্নত ছিল না। খুবই খারাপ রাস্তা। ব্যাগ পেটরা হাতে নিয়ে তিনি পায়ে হাঁটা শুরু করলেন। ব্যাগটা অন্য কাউকে তিনি নিতে দিলেন না।

কেন্দ্রিয় অফিসে এক সময় কোন গাড়ী ছিল না। ’৭৭ সালের দিকে একটি মাত্র পুরানো মডেলের গাড়ি কেনা হয়। আগেই বলেছি দেশের রাস্তা ঘাট তখন উন্নত ছিলো না। আন্তঃজেলা এক্সপ্রেস ট্রেন ছিলনা। অত্যাধুনিক তো দূরের কথা, ডাইরেক্ট কোন বাস সার্ভিসও ছিলনা। অথচ সে সময় নেতৃবৃন্দ যেভাবে বিভিন্ন জেলায় সফর করতেন-- তা আজকের প্রেক্ষাপটে ভাবতে অনেকের কাছেই রূপকথার মতো লাগবে। শহরগুলোতে রিকশায় বা সাইকেলে চড়ে, মফস্বল এবং গ্রামগুলোতে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তারা কাজ করেছেন। আন্দোলনের কাজকে সংগঠিত করেছেন। মগবাজার কেন্দ্রিয় অফিস থেকে তার বাসা ছিল দূরে। বাসা থেকে যেতে আসতে প্রায়ই গাড়ীর দরকার হতো। যেদিন গাড়ী পাওয়া যেতো না তিনি বেবী টেক্সীতে চলে আসতেন। বহুবার তিনি আমাকে বলেছেন যে, গাড়ী না থাকলে আমাকে একটু আগে জানাবেন, আমি রোডের বেবীতে চলে আসবো।

জন্ম ও শিক্ষা:
জনাব ইউসুফ আলী গাজীপুর জিলার কালীগঞ্জ থানাধীন বড়গাঁও-এ ১ মার্চ ১৯৪২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী ঢাকাস্থ ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ (বর্তমানে কবি নজরুল কলেজ) থেকে ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় চতুর্দশ স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ঊপড়হড়সরপ বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। অতপর ১৯৬২ সালে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবন:
১৯৬৩ সালে অধ্যাপক ইউসুফ আলী সাংবাদিক হিসেবে ‘সাপ্তাহিক ইয়ং পাকিস্তানে’ কাজ শুরু করেন। অতপর সাংবাদিকতা ছেড়ে ১৯৬৪ সালে মৌলভীবাজার ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর একই বছরে তিনি নরসিংদী ডিগ্রি কলেজে যোগদান করেন এবং ১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত উক্ত কলেজে অধ্যাপনা করেন।

ইসলামী আন্দোলন ও রাজনৈতিক জীবন:
অধ্যাপক ইউসুফ আলী প্রায় চার যুগ ধরে ইসলামী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শাহ আবদুল হান্নানের নিকট থেকে (বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব) সর্বপ্রথম ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত পান। অতপর এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ খুররম জাহ্ মুরাদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে যান এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রতি আকর্ষণ আরো বেড়ে যায়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৯ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘে যোগদান করেন। ১৯৬১-৬২ সেশনে ঢাকা মহানগরীর ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক ইসলামী ছাত্র সংঘের মজলিসে শুরার সদস্য নির্বাচিত হন।

ছাত্র জীবন শেষে তিনি ১৯৬৪ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেন এবং একই বছরে জামায়াতের রুকন হন। ১৯৬৬-৬৭ সালে ঢাকা জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিভাগের আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীর যুগ্ম সেক্রেটারী এবং ১৯৮৮ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীল প্রকাশনী এবং সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পরিচালনা বোর্ডের ব্যবস্থাপনার পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরো প্রতিষ্ঠা এবং আধুনিক প্রকাশনীর সাথেও তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

সমাজসেবা:
সমাজ কর্মী হিসেবে কালীগঞ্জ থানায় তিনি ছিলেন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি বিভিন্ন স্কুল, মাদরাসা ও ইয়াতিমখানার সাথে জড়িত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি ঢাকার তা’মিরুল মিল্লাত ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী, গাজীপুর ইসলামী ট্রাস্ট এবং কালীগঞ্জ আল-ইসলাহ ট্রাস্টের সভাপতি ছিলেন।
উল্লেখ যে, বাংলাদেশের বিখ্যাত মাদরাসা ‘তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা’ তা’মীরুল মিল্লাত ট্রাস্টের পরিচালিত প্রতিষ্ঠান।
এছাড়াও তিনি তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মাঝে অন্যতম।

লেখক হিসেবে:
অধ্যাপক ইউসুফ আলী আল্লাহর দ্বীন কায়েমের আন্দোলনের সাথে সাথে লেখার কাজও করেছেন এবং বেশ কিছু বই লিখেছেন। তার মধ্যে- (১) অর্থনৈতিক সাম্য ও ইসলাম (২) মু’মিন জীবনের বৈশিষ্ট্য (৩) বাংলাদেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত (৪) ইসলামী আন্দোলনমুখী পরিবার গঠন (৫) ইসলামী আন্দোলনের জনশক্তির আত্নগঠন (৬) ইসলামী বিপ্লব সাধনে সংগঠন (৭) কুরআনের আলোকে মানব জীবন ও (৮) মু’মিনের পারিবারিক জীবন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার লেখা বইগুলো খুবই সহজপাঠ্য।

অধ্যাপক ইউসুফ আলী ১৯৭৯ ও ১৯৮২ সালে দু’বার হজ্জব্রত পালন করেন। রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত করাচীতে আন্তর্জাতিক ইসলামিক অধিবেশনে তিনি যোগদান করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী সাহেবের স্ত্রী ও ২ ছেলে জামায়াতের রুকন। তার দুই ছোট ভাই কৃষিবিদ ইদরীস আলী এবং কবি আসাদ বিন হাফিজও জামায়াতের রুকন।

ইন্তেকাল:
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী ২০০৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লায় সাংগঠনিক সফরকালীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন।

লেখকঃ

অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম

সাবেক কেন্দ্রীয় অফিস সেক্রেটারি

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।