১৫ অক্টোবর ২০১৬, শনিবার

২৮ অক্টোবর পল্টন থেকে খাদিজা পর্যন্ত আওয়ামী জঙ্গিপনার রক্তাক্ত দলিল

আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে কথা। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর প্রানকেন্দ্র পল্টন ময়দানে আওয়ামী-বামরা প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে যে পৈশাচিক কায়দায় জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার পর লাশের উপর নৃত্য করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল! ২৮ অক্টোবর এটি একটি কালো অধ্যায়ের দিন। একটি কলঙ্কের সংযোজনের দিন। এ দিন মানবাধিকার ভুলন্ঠিত দিবস, লগি-বৈঠার তান্ডব দিবস, আওয়ামী বর্বরতার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

যুগে-যুগে ইতিহাসের কালো অধ্যায় জুড়ে রয়েছে ক্ষমতার লিপ্সা, ভূমি দখল, সম্পদ আহরণ। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিশ্বযুদ্ধ, ক্রুসেড (ত্রিপলী), চায়না বিপ্লব, বোসনিয়া/চেচনিয়া, ইরাক, আফগান মুসলিম গণহত্যা, লেলিন বিপ্লব, স্ট্যালিন বিপ্লব, হিরোশিমা নাগাসাকি, ২৫ মার্চের কালো রাত্রি, এপ্রিল ফুল দিবসের ঘটনা ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ সমূহ। হিটলার, মুসোলিনী, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, কুবসাই খান, খেসারু হত্যা, আমাদের স্মৃতিতে এক বীভৎস চিত্র ভেসে ওঠে। এরকম অনেক জঘন্য ঘটনার সাথে ২৮ অক্টোবরও স্থান করে নিয়েছে।

২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে পল্টনে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার দৃশ্য স্মরণ করলে এখনো শিউরে উঠে মানুষের শরীর, বাকরুদ্ধ হয় বিবেক। পৈশাচিক ও অমানবিকভাবে মানুষ হত্যার দৃশ্য এখনো কাঁদায় সকলকে। বিশ্বমানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী খুনীদের প্রতি ঘৃনা ও অভিশাপ দিতে থাকবে। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী জঙ্গিপনার এক রক্তাক্ত দলীল হিসেবে ইতিহাসে চিন্হিত হয়ে থাকবে। Terrorism এর সংজ্ঞায় Britannica R.R. ENCYCLOPEDIA-তে বলা হয়েছে-Terrorism Systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective.

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে। এই হামলা চালানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। অত্যান্ত ঠান্ডা মাথায় এ জমিন থেকে ইসলামী আন্দোলন নিশ্চিন্হ করে ও নেতৃত্বকে হত্যা করাই ছিল উদ্দেশ্য। সে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক আমীর ও মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সহ পাঁচজনকে ফাঁসির কাষ্টে ঝুলিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। দুইজন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে জুলুমের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

২৮ অক্টোবর মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য ইতিহাস দিয়ে আওয়ামীলীগ-বামরা যাত্রা শুরু করেছে, অপরাধের মাত্রা দিন দিন ভয়ংকর রুপ ধারণ করে সিলেটে এমসি কলেজে খাদিজার উপর নগ্ন হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল। আওয়ামী লীগের শাসন আজ আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাতে বসছে।

২৮ অক্টোবর সেদিন ঘটনার শুরু যেভাবে-
আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগের কথা। ২৮ আক্টোরর ২০০৬ ছিল চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার ৫ বছর বর্ষপূর্তির দিন। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই দিনে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে আয়োজন করা হয়েছে জনসভার। মুলত ২৭ আক্টোরর থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে অনেককে হত্যা করে। ২৮ অক্টেবর সকাল ১০টায় আমরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পল্টনস্ত কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে তার মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথার এক পাশ ঝুলছে! দেখে শরীর শিহরে উঠছে!।

অফিস থেকে বেরিয়ে আহত-রক্তাক্তদের দেখতে দেখতে আমরা পল্টন মসজিদের গলিতে এসে দেখি একদিকে ৪০-৫০ জন নিরীহ নিরস্ত্র,অপরদিকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার থেকে পাঁচ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে অস্ত্র, লাঠি, বোতল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা ব্যবহার করেনি। এভাবে ৭ ঘণ্টা মরনপণ লড়াই। তাদের উদ্দেশ্য জনসভা ভন্ডুল করা, নেতা-কমী ও আমাদের দলীয় অফিসের উপর আক্রমন। কিন্তু ওরা এক ইঞ্চি জায়গা থেকেও সরাতে পারেনি আল্লাহর দ্বীনের গোলামদের। এ যেন শাহাদাতের প্রতিযোগিতা। আগামীর পথে এক দুরন্ত সাহস। ২৮ অক্টোবরের আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের বাস্তব সাক্ষী। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ কেউ আহত হয়ে বিদায় নিচ্ছে আমাদের কাতার থেকে। নতুন করে, দু-একজন করে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা এর থেকে বাড়ছে না। কারণ বিজয় তো সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।

হঠাৎ সামনের দিক থেকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রচন্ড আক্রমন শুরু করে। আমরা ২০/২৫ জন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম তখন দেখি আওয়ামীলীগের ৪-৫ হাজার অস্ত্রে সস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী পেছনের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে তাঁর সাহায্য অনিবার্য, এটাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘‘কোনো মু’মিন মুজাহিদ জিহাদের ময়দানে নারায়ে তাকবির উচ্চারণ করলে বাতিলের মনে চার হাজার লোক তাকবির উচ্চারণ করলে যে আওয়াজ হয় তার সমপরিমাণ ভীতি সৃষ্টি হয়।’’ ২৮ অক্টোবর হাতে নাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।

আমরা সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। তার দেহ এখন নিথর নিস্তব্ধ। তিনি শাহাদাতের অমিয় সূধা পান করে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাংখিত মঞ্জিলে। শাহাদাতের যে মৃত্যুর জন্য তিনি প্রায় তার মায়ের কাছে দোয়া চাইতেন। মাবুদ আজ তার আকাঙ্খা পূর্ণ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ।

মুজাহিদ তাঁর মাকে বলত, “মাগো বেশি বেশি কুরআন পড়ো, তাফসির সহকারে, আমল করার লক্ষ্যে কুরআনকে হৃদয়ে ধারণ করো। সে রেগুলার তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তো, নফল রোজাও রাখতো। মাগো, শহীদ হতে চাইলেই কি শহীদ হওয়া যায়? যায় না মা। শহীদ হতে হলে অনেক বড় ভাগ্য লাগে, সত্যিকারার্থে আমার কি সেই ভাগ্য আছে মা, মাগো শহীদ হলে কর্মফলের কোন হিসাব দিতে হয় না, কোন শাস্তি হয় না কবরে, জাহান্নামে যেতে হয় না। শাহাদাত হলে সরাসরি জান্নাতে যাওয়া যায়”।

শহীদরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও তারা যেন অমর!। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (আল-বাকারা: ১৫৪)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, “তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অত:পর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) প্রিয় রাসুল (সা) বলেছেন: ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিযী)

হায়েনারা আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদকে হত্যার পর ফেলে রেখেছে গলির মধ্যে। কয়েকজন মিলে যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তের পিপাসা তখনও থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুজাহিদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। পরে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম প্রিয় ভাই মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা।

এ পর্যায়ে দীর্ঘ ৫/৬ ঘণ্টা পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পিস্তলের গুলি আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো লুটিয়ে পড়লাম। কয়েকজন ভাই কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। পায়ের যন্ত্রণায় যতটুকু কাতর তার থেকে বেশি কষ্ট লাগছে এই ধন্য মানুষগুলোর কাতার থেকে এই অধমের বিদায় নিতে হচ্ছে এ জন্য। তখন নিজেকে খুব স্বার্থপরই মনে হচ্ছিল। সবাই যখন জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছে তখন আমি চলে যাচ্ছি অন্যের কাঁধে ভর করে। গুলিবিদ্ধ পা-টি ঝুলছে আর সেই সাথে রক্ত ঝরছে। কষ্টের মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। অনেক ভাই পেরেশান হয়ে গেল এবং আমার সাথে আসতে লাগল। ভাইদের বললাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।

আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। এ যেন আরেক কারবালা। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে দারুণ শৃঙ্খলা শহীদী কাফেলার ভাইদের মাঝে। এখানেও ইয়ামামার যুদ্ধের সেই সাহাবীদের মত অপর ভাইকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টান্ত। নিজেদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে তবুও ডাক্তারকে বলছেন, ঐ ভাইকে আগে চিকিৎসা করুন। এ যেন ‘বুন ইয়ানুম মারসুস’ এর উত্তম দৃষ্টান্ত। এ যেন আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত দলিল। জোহরের নামাজ আদায় করলাম অপারেশন থিয়েটারে গুলিবিদ্ধ পা প্লাস্টার করা অবস্থায়। নিজের অজান্তেই ভাইদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। প্লাস্টার করছেন ডাক্তার। এক্সরে রিপোর্ট ঝুলানো দেখা যাচ্ছে পায়ের হাড় দ্বিখ-িত হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম এই এক্সরে টি আমার? কেউ যেন বলতে চেয়েও আমি ভয় পাবো সে জন্য আর কিছু বলতে চায়নি। আমি বললাম, এই গুলিটি আমার জন্য আল্লাহ কবুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুলিটি আমার পায়ের নামেই লেখা ছিল। এ বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকের। এই বিশ্বাসের ইমারতের ওপর যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এলেও তাকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না ইনশাআল্লাহ।

আজ হয়তো কেউ কেউ বলেন ২৮ অক্টোবরে আমাদের প্রস্তুতির কথা। কিন্তু যদি আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো থাকতো! তাহলে কি হতো? কারণ দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মোকাবেলা করেছি, কী তাদের পরিচয়? আওয়ামী লীগ ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই, গার্মেন্টস কর্মী ও হিন্দার মত লোকদের নিয়ে এসেছে। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। আমাদের প্রস্তুতি আরো ভাল হলে সেদিন লাশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেতো। আর এ ধরনের একজন সন্ত্রাসী, টোকাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া, নামাজী, আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের লাশ সবাই একই হিসেবে মূল্যায়ন করতো। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে হিসাব হতো কাদের কয়টি লাশ। অন্তত আল্লাহ তায়ালা সে কলঙ্কের হাত থেকে এ আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যে এই আন্দোলনের কল্যাণ নিহিত। ২৮ অক্টোবর বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি কারা। কিন্তু আজও ভাবি আওয়ামীলীগ আর কত সন্ত্রাস, খুন, গুম করলে তাদের জঙ্গি বলা হবে?

পল্টনে এ জাতি আরেকবার দেখে নিয়েছে আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। শ্রদ্ধেয় সাবেক আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। যা ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। তিনি যেন মাওলানা মওদূদীর অবিকল প্রতচ্ছবি। শহীদ নিজামী সহ সে ষ্টেজে যে শীর্ষ নেতাদের রক্ষা করতে অনেকে জীবন দিয়েছে তাঁরা অনেকেই আজ নিজেই শাদাদাতের অমিয় সুধা পান করে চলে গেছেন আমাদের মাঝ থেকে।

কিন্তু আমি জানি না ২৮ অক্টোবরের ঘটনা পর্যালোচনা ১৪ দল কিভাবে করছে। আজ যদি বলা হয়, এই দুনিয়ার বিবেচনায় ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কে? কেউ বলবে, শহীদ মাসুম, শহীদ শিপন, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ রফিক, শহীদ ফয়সলের পরিবার।

কিন্তু না। এটি আমার-আপনার হিসাব হতে পারে! তবে শহীদ পরিবারের অনুভূতিতো ভিন্ন। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য।

শহীদ মুজাহিদের মায়ের অনুভূতি “২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার জীবনের সবেচেয় বড় স্মরণীয় দিন, সবচেয়ে বেদনার দিন এবং সবচেয়ে বড় শুকরিয়া আদায়ের দিন। এই দিনে আমার রক্তের বাঁধন ছিন্ন করে মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করলো। সে ছিল আমার অতিপ্রিয় সন্তান। সে ছিল পরম প্রিয় বন্ধু। আমার জীবনের যত কষ্ট, যন্ত্রণা, বোবা কান্না তা শুধু তার সাথে শেয়ার করেছি, অন্য কারো সাথে নয়। আজ সে নেই তাই আমার অব্যক্ত বুকফাটা আর্তনাদ। তার মত ভালো আমলের ভালো ছেলে পরকালে আমি পাবো তো? এই জীবনে তাকে আমি কিছু দিতে পারিনি তাই আল্লাহকে বলি, হে আল্লাহ এই জীবনে যতটুকু পুণ্য করেছি এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যা পুণ্য অর্জন করবো, তার সবটুকু সওয়াবই আল্লাহ যেন তার আমলনামায় যোগ করে দেন”।

শহীদ ফয়সালের মায়ের অনুভূতি- “সেই ভয়াবহ ২৮ অক্টোবর সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা ভুলার মত নয়, ফয়সালকে হারিয়ে আর স্ব^াভাবিক জীবনে ফিরে আসা ‘মা’ হয়ে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ছিল খুবই নরম স্বভাবের। এমন ছেলেকে লগি-বৈঠা দিয়ে জীবনে শেষ করে ফেলা এটা মানুষের কাজ নয়, এরা নরপশু, ওদের মায়ামমতার লেশমাত্র নেই। আল্লাহর পছন্দনীয় সবদিক থেকে সুন্দর বান্দাটিকেই তার কাছে নিয়ে গেলেন। শহীদদের স্বভাবটা এরকমই হয়ে থাকে। আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীন ওদেরকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন”।

শহীদ হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন মা বলেন-”সে দাখিলে ১১তম স্থান অধিকার করে। মানুষের যেকোন বিপদ কিংবা সমস্যা সমাধানে সে দ্রুত সাড়া দিত। এক ছেলের অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা উঠলে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির পর দেখা গেল তার ওষুধের টাকা নেই। সে তার নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ঐ ছেলের ওষুধ কিনে দেয় এবং সারারাত তার বিছানার পাশে থেকে শুশ্রƒষা প্রদান করে ভোরে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে। এলাকার এক বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিলে ঐ লোকটিকে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। সরকারি বিজ্ঞান কলেজে অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে হিন্দু ছেলেরা পর্যন্ত বায়তুলমালে অর্থ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করত। শিপন এলাকার অনেক ছেলেকে কুরআন শরিফ পড়তে শিখিয়েছে।

এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে ভাল করতে হবে এই চিন্তায় সে সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। সে সবাইকে মসজিদে নামাজ এবং কুরআনের আলোকে জীবন গড়ার তাগিদ দিতে ব্যতিক্রম আয়োজনের মাধ্যমে তাদেরকে দাওয়াত পৌঁছাতো। যেমন- ব্যায়াম, ফুটবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন। ফজরের নামাজের সময় ছেলেদেরকে নামাজের জন্য ডাকতো।

আমার শিপনকে যেরকম নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছে আমার ছেলে কুরআনে হাফেজকে তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার দাঁত পর্যন্ত শহীদ করেছে- তাই আমি এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি চাই এবং ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয় এবং কোন সন্তানকে যেন এভাবে না মারা হয়”।

শহীদ রফিকুল ইসলাম-এর মা বলেন-”রফিকুল শিবির করার পর থেকেই নামাজ পড়তে বলত, গ্রামের মানুষ ঝগড়া করলে সে আমাদের সেখান থেকে দূরে থাকতে বলত। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর খাওয়া শেষ করে রফিকুল যখন চলে যাচ্ছে তখন ওর খালা ও আমি বাড়ি থেকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। কে জানত যে, সেটাই তার শেষ দেখা?

আমার ছেলেকে হারানোর দু-একদিন পর এক রাতে ঘুমের মাঝে আমার ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এলো। আমি তার সাথে কথা বললাম। আমি বললাম ‘তুই না মরে গেছিস?’ সে বলল- ‘আম্মা, এ কথা আর কখনো তুমি বলবে না। আমি মরে যাইনি, আমি শহীদ হয়েছি।’

হ্যাঁ সে ইসলামের জন্যই শহীদ হয়েছে, আর আমি তার গর্বিত মা। আমার ছেলের কোন অপরাধ ছিল না। সে এলাকার ছেলেদের কুরআন শেখাতো, নামাজ পড়াতো। এতো সুন্দর সোনার টুুুুুুকরো ছেলেকে যে আওয়ামী হায়েনারা আঘাতের পর আঘাতে আমার বুক খালি করিয়েছে আমি তাদের বিচারের অপেক্ষায় আছি। যদি দুনিয়ায় দেখে যেতে নাও পারি তবে অবশ্যবই সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক মহান আল্লাহর দরবারে বিচার দেখবো ইনশাআল্লাহ।

শহীদ মাসুমের মায়ের অনুভূতি এমন- “মাসুম লেখাপড়ার পাশাপাশি কুরআন-হাদিসের চর্চা করে এবং আমল করে। ছাত্রশিবিরের একজন ছাত্রকে পিতামাতার চক্ষুশীতলকারী সন্তান হিসেবে সমাজে উপহার দেয়। অভাবীদের ও গরিব ছাত্রের ভর্তির টাকার ব্যবস্থা করে নিজের প্রিয় পছন্দের জামাটি পরিয়ে দিয়ে তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শহীদ মাসুম।

লেখাপড়ায়ও মেধাবী ছিল। মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ ৩টি লেটারসহ ও বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইএসসি পাস করে ইংলিশে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। আওয়ামী-সন্ত্রাসীরা তাকে মেরে ফেলল এ কথাটি এখনো এলাকাবাসী সহ্য করতে পারছে না।

আল্লাহর কাছে চলে যাওয়ার পর এখন বুঝি কী সম্পদ হারিয়েছি। ওকে আমি একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। সেই মাসুমকে ছাড়া আমি চোখের পানিকে সাথী করে বেঁচে আছি। সব আছে মাসুম নেই।

আমাদের সন্তানরা নিহত হয়েছে তার সোনার ছেলেদের লগি-বৈঠার আঘাতে। আওয়ামী লীগ কোনভাবে অস্বীকার করতে পারবে না। তিনি বলেছিলেন, লগি-বৈঠা, ঢল নিয়ে আস।’

আল্লাপাক অবশ্যই তার বিচার করবেন। এই জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই আমরা শহীদের মা হতে পেরেছি। আল্লাহর পথে বাধা দিতে গিয়ে তারাই ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে ফেরাউন ও নমরূদের মত।

এই আটাশে অক্টোবরে নতুন করে শহীদদের আত্মদানের কথা স্মরণ করে আমাদের দ্বীন কায়েমের পথ চলা হোক আরো বেগবান।”

বাংলার জমিনে প্রতিটি মুহুর্তে আজ শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তান হারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাই হারা বোনের আর্তনাদ, পিতা হারা সন্তানের করুন চাহনী, মা হারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণী পেশার মানুষ। আমীরে জামায়াত থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বণিতা এমনকি অনেক নিষ্পাপ শিশুও শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করেছেন। আর এর মধ্যে দিয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক বেশী জনপ্রিয় ও জনমানুষের আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। হক ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস।

২৮ অক্টোবর পল্টনে শাহাদাতের নজরানার মধ্য দিয়ে রাজপথে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা এ জমিনে বিজয়ের সূচনা করবে ইনশাআল্লাহ। হে বিস্তীর্ণ আকাশ ও জমিনের মালিক! তুমি আমাদের ফরিয়াদকে কবুল কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও। আমীন।